• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

যেভাবে প্রিয় নবী (সা.) রমজান যাপন করতেন

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১০ মে ২০২০  

আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় সময় হচ্ছে রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনা। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব সময়ের সব মানুষের জন্যে পরিপূর্ণ আদর্শ হিসেবে নির্বাচন করেছেন। ফলে তিনি পরিপূর্ণ আদর্শের ক্ষেত্রে যখন সবার জন্য অনুসরণীয় ফলে ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রেও তিনি আরো অধিক মাত্রায় সবারর জন্য অনুসরণীয়।

 

হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে অনুসরণ করেই মানবজাতি পার্থিব ও অপার্থিব সব কাজে সফলকাম হতে পারে। ফলে রমজানের মতো একটি বিষয়ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে কাটাতেন তাও মুমিন মুসলমানদের জানা ও আগ্রহের বিষয়।

 

রাসূলের (সা.) জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই রমজান মাসে রাসূল (সা.) এর জীবনে প্রধানত দু’টি বিষয় খুব যত্নের সঙ্গে পালিত হতো। এক. বুখারী শরিফে উদ্ধৃত হয়েছে, রমজানের প্রতি রাতে হজরত জিবরাঈল (আ.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরআন তেলাওয়াত করে শুনাতেন। সাধারণত হজরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের অধিকাংশ সময় তাহাজ্জুদ পড়ে কাটাতেন। তবে রমজান এলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাহাজ্জুদের সঙ্গে সঙ্গে তেলাওয়াত ও নফল নামাজের মাত্রা আরো বেড়ে যেতো। তাঁর জন্য আল্লাহ জাল্লা শানুহুর পক্ষ থেকে দেয়া এ নফল ইবাদতই আজকের পৃথিবীতে মুসলমানরা তারাবি হিসেবে পালন করে থাকেন। হজরত জিবরাইল (আ.) রমজানের রাতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনতেন যিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছে কোরআন নিয়ে এসেছিলেন। তারই অনুসরণে আজও পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশে সব মুসলমানরা একই ছন্দে একই সুরে তারাবির নামাজে একজন কোরআন তেলাওয়াত করেন, বাকিরা শুনে থাকেন। 

 

রাসূল (সা.) এর জীবনে রমজান সাধনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রমজানের শেষ দশকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতেকাফ পালন করতেন। এই ইতেকাফ পালন করার ক্ষেত্রে যেমন প্রিয় নবী যত্মবান হতেন তাঁর পাশাপাশি তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁর বন্ধুদেরও উৎসাহিত করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর রমজানের রোজা ফরজ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত কখনো রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ ছাড়েননি। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদলে যদি কোনো বান্দা রমজান মাস পালন করেন, রমজানের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ও কল্যাণ হাসিল করতে চায় তাহলে উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি সবাইকে অধিক হারে যত্নবান হতে হবে। এছাড়াও ইবাদতের বিবিধ উপকরণ দ্বারা রাসূল (সা.) রোজার দিবসগুলোকে শোভিত করতেন। অত্যন্ত আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সঙ্গে তিনি সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন। রোজা ভাঙার সময় হলে দ্রুত ইফতার করে নিতেন। পক্ষান্তরে সেহরি করতেন অনেক দেরিতে, সুবেহ সাদিকের কিছু আগে। ইফতার করতেন ভেজা বা শুকনো খেজুর অথবা পানি দিয়ে। ভেজা খেজুর দিয়ে সেহরি করাকে পছন্দ করতেন তিনি। জাঁকজমকহীন স্বাভাবিক সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন সবসময়।

 

রমজানে রাসূলের এ আচরণ বিষয়ে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল (সা.) সালাত আদায়ের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, যদি ভেজা খেজুর না থাকত, তবে সাধারণ শুকনো খেজুরই গ্রহণ করতেন। যদি তাও না থাকত, তবে কয়েক ঢোক পানিই হতো তার ইফতার (তিরমিজি : ৬৯৬)। উপরিউক্ত কিছুই যদি না থাকে, তবে রোজাদার যে কোনো হালাল খাদ্য দিয়ে ইফতার করে নেবে। তবে খাদ্যই যদি না থাকে, তাহলে ইফতারের নিয়ত করবে। ইফতারের নিয়তই হবে তার জন্য ইফতার। আবু আতিয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং মাসরুক আয়েশা (রা.) এর কাছে উপস্থিত হলাম। মাসরুক তাকে উদ্দেশ করে বলল, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই সাহাবি উপস্থিত হয়েছে, যাদের কেউ কল্যাণে পশ্চাৎবর্তী হতে আগ্রহী নয়; তাদের একজন মাগরিব ও ইফতার উভয়টিকেই বিলম্ব করে, অপরজন দ্রুত করে মাগরিব ও ইফতার। আয়েশা বললেন, কে মাগরিব ও ইফতার দ্রুত করে? বললেন, আবদুল্লাহ। আয়েশা উত্তর দিলেন, রাসূল (সা.) এভাবেই রোজা পালন করতেন। (মুসলিম : ১০৯৯)।

 

আবদুল্লাহ বিন আবি আউফা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রমজান মাসে আমরা রাসূলের সঙ্গে সফরে ছিলাম। সূর্য অস্তমিত হলে তিনি বললেন, হে অমুক! নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এখনো তো দিবসের কিছু বাকি আছে। রাসূল আবার বললেন, নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। বর্ণনাকারী বলেন, সে নেমে এসে ছাতু ও পানির ইফতার প্রস্তুত করে রাসূলের সামনে উপস্থিত করলে তিনি তা গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি হাতের ইশারা দিয়ে বললেন, সূর্য যখন এখান থেকে এখানে অস্ত যাবে এবং রাত্রি আগত হবে এতটুকু অবধি, তখন রোজাদার রোজা ভাঙবে (বুখারী : ১৯৪১, মুসলিম : ১১০১)।

 

জনৈক সাহাবির সূত্র ধরে আবদুল্লাহ বিন হারেস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলের কাছে হাজির হলাম, তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন। রাসূল বললেন, নিশ্চয় তা বরকতস্বরূপ, আল্লাহপাক বিশেষভাবে তা তোমাদের দান করেছেন সুতরাং তোমরা তা ত্যাগ করো না (নাসায়ি : ২১৬ )। হজরত জায়েদ বিন সাবেত থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলের সঙ্গে সেহরি খেলাম, অতঃপর তিনি সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। আমি বললাম, সেহরি ও আজানের মধ্যবর্তী সময়ের স্থায়িত্ব কতটা? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ দৈর্ঘ্য (বুখারী : ১৯২১)। দেরিতে সেহরি গ্রহণ রোজার জন্য সহজ, রোজাদারের জন্য প্রশান্তিকর।

 

রাসূলের (সা.) রমজান যাপনের আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা রেখেও মেসওয়াক করতেন। আমের বিন রাবিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অসংখ্যবার রোজাবস্থায় মেসওয়াক করতে দেখেছি। (তিরমিজি : ৭২৫)। মেসওয়াকের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদিসে এসেছে মেসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী (আহমদ : ৭)। অপর হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মেসওয়াকের ব্যাপারে আমাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, এমনকী, একসময় আমার মনে হয়েছিল যে, এ ব্যাপারে আমার ওপর কোরআন কিংবা ওহী নাজিল হবে (আহমদ : ২২/৩)। সুন্নতের অনুসারীদের অবশ্য কর্তব্য বিষয়টির প্রতি যত্নশীল হওয়া। কারণ, এর প্রতিদান অঢেল, উপকারিতা অগণিত। রাসূলের (সা.) অন্য হাদিসে বর্ণিত একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি করবে না। উক্তিটি হচ্ছে মেশকের সুঘ্রাণের চেয়েও আল্লাহর নিকট রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ অধিক প্রিয় (বুখারী : ১৮০৫)। এ হাদিসটির ফলে একদল মনে করেন, দিবসের শেষে মুখের দুর্গন্ধ যাতে দূর না হয় তাই মেসওয়াক করা মাকরূহ। দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থাকার ফলে দিবসের শেষান্তে রোজাদারের মুখ দুর্গন্ধে ভরে যায়। রোজাদারের ক্ষেত্রে মেসওয়াকের মাসআলায় উলামারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, কেউ মনে করেন : শর্তহীনভাবেই রোজাদার ব্যক্তি মেসওয়াক করতে পারবেন। কেউ বলেন : সূর্য হেলে পড়ার পর মেসওয়াক করা মাকরূহ, এর পূর্বে মোস্তাহাব। কেউ বলেন : কেবল আসরের পরই মেসওয়াক করা মাকরূহ হবে, অন্য সময় নয়। অপর কারো মত এই যে, বিষয়টিকে ফরজ ও নফলের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দেখা হবে। রোজা যদি ফরজ হয়, তবে সূর্য হেলে পড়ার পর হবে মাকরূহ, নফলের ক্ষেত্রে মাকরূহ হবে না। কারণ, এ পদ্ধতিটিই রিয়া হতে অধিক মুক্ত। প্রথম মতটিই অধিক যুক্তিযুক্ত। ইবনে উলয়া বলেন : রোজাদার কিংবা পানাহারকারী উভয়ের জন্যই মেসওয়াক করা সুন্নত। শুকনো কিংবা ভেজা মেসওয়াক দুটোই এ ক্ষেত্রে বরাবর। (ইবনে আব্দুল বার : তামহিদ ৭/১৯৯)।

 

মূলত রাসূল (সা.) আমাদের জন্য হেদায়েতের যে আদর্শ রেখে গেছেন, তার পুণ্যবান সহচররা সমুন্নত করেছেন যে আদর্শ ও কর্মনীতির মৌল-পন্থা, তার অনুসরণ ও অনুবর্তনেই সাফল্য ও কল্যাণ নিহিত। আমরা যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণের মাধ্যমে রমজান মাসকে কাটাতে পারি এবং বিশেষ করে শেষ দশকে ইতিকাফে কাটিয়ে শবে কদর হাসিল করতে পারি তাহলে রমজান আমাদের সবার জন্য হয়ে উঠবে বিজয় ও সফলতার মাস। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বুঝবার ও মানবার তাওফিক দিন। আমিন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর