• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

নভোচারীদের খাবার ‘কিনোয়া’ চাষে বদলে যাবে কৃষকের ভাগ্য

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারি ২০২২  

বাংলাদেশের নীলফামারীতে নভোচারীদের খাদ্য হিসেবে পরিচিত 'কিনোয়া'র চাষ শুরু হয়েছে। কিনোয়া সবচেয়ে বেশি চাষ হয় উত্তর আমেরিকাতে। ওষুধি ও পুষ্টিগুণে ভরপুর এই দানাশস্য পুষ্টিহীনতা রোধে তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনা।

কিনোয়া পাতা ও বীজ দেখতে শাকের মতো হলেও এই ফসলে রয়েছে উচ্চমাত্রার হজমযোগ্য প্রোটিন। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদান।

পুষ্টিগুণে ভরপুর, এই ফসল উৎপাদন শুরু হয়েছে নীলফামারীতে। ধান বা সবজি উৎপাদনের চেয়ে দশগুণ বেশি দাম পাওয়া গেলেও কৃষকরা চিন্তিত এর বাজার ব্যবস্থা নিয়ে।

আন্তর্জাতিক বাজারে কিনোয়ার ব্যাপক চাহিদা আছে। তবে, বাংলাদেশে এখনো সেভাবে মার্কেট গড়ে ওঠেনি। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে কিনোয়ার চাহিদা আছে। বাংলাদেশে ভোক্তাদের অগ্রিম চাহিদা দিয়ে আমদানিকৃত প্রতি কেজি কিনোয়া কিনতে হচ্ছে ১৬০০ টাকা দরে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, কিনোয়া আবাদে কৃষকের ভাগ্য পাল্টে যাবে। দীর্ঘ গবেষণার পর, কিনোয়া চাষ ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক।

শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রোনমির প্রফেসর ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, আমি পাঁচ বছর গবেষণার পর পাইলটিং করতে মাঠ পর্যায়ে কিনোয়া চাষ শুরু করেছি। ফলাফলও আশানুরূপ। আমার আবেদনের পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে কিনোয়া চাষের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। খরা প্রবণ ও লবণাক্ত দুই ধরনের জমিতেই কিনোয়া চাষ সম্ভব। নভেম্বরের মাঝামাঝি এ ফসল চাষ করে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে মাঝামাঝি সময় ফলন ঘরে তোলা যায়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে কিনোয়ার মার্কেট তৈরি হলে আমাদের কৃষক কিনোয়া চাষ করে লাভবান হতে পারবেন। দেশে কিনোয়ার মার্কেট তৈরিতে কাজ চলছে। উৎপাদিত কিনোয়া বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে।

প্রফেসর ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস আরো বলেন, কিনোয়া হলো হাউ প্রোটিন সম্পন্ন খাবার। এটিকে সুপার ফুডও বলা হয়। কিনোয়া অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে এবং লাইসিন সমৃদ্ধ, যা সারা শরীর জুড়ে স্বাস্থ্যকর টিস্যু বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কিনোয়া আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন-ই, পটাসিয়াম এবং ফাইবারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। রান্না করা হলে এর দানাগুলো আকারে চারগুণ হয়ে যায় এবং প্রায় স্বচ্ছ হয়ে যায়।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এটি নিয়ে গবেষণা করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছে।

 

কিনোয়া কী

চাল, গম বা আলুর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হোল গ্রেইন খাদ্য, যেমন ওটস বা যব, ফক্স টেল মিলেট (কাউন), বার্লি, কিনোয়া ইত্যাদির প্রচলিত করার ব্যাপারে যুগ যুগ ধরেই তাগিদ রয়েছে পুষ্টিবিদের তরফ থেকে। আবার এসব বিকল্প শর্করা খাদ্যের মধ্যে কিনোয়া কিন্তু একেবারেই আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর কারণ হচ্ছে এটি আসলে বিট–জাতীয় এক গাছের বীজ। এটি প্রকৃতপক্ষে খাদ্যশস্য নয় বলে একে সিউডোসিরিয়াল বা ‘মিছামিছি শস্য’ বলা হয়। রান্না করলে এই কিনোয়াবীজ প্রায় চারগুণ ফুলে–ফেঁপে ওঠে এবং কিছুটা স্বচ্ছ দানাদার আকৃতি ধারণ করে। মৃদু স্বাদের কিনোয়া একেবারে গলে যায় না এবং কিছুটা চিবিয়ে খেতে হয়।

কিনোয়া খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত প্রাচীন। উৎপত্তিগত দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার এই ফসলের নিদর্শন ও বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাচীন ইনকা সভ্যতার সাক্ষী সব পুরাকীর্তি খুঁজতে গিয়ে। নৃতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, সেই সাত হাজার বছর আগেই দক্ষিণ আমেরিকার আন্দেস অঞ্চলে কিনোয়া ফলানো হতো। ইনকা ভাষায় একে কিনোয়া বা খাদ্যশস্যের জননী বলা হতো। একে পবিত্রও মনে করা হতো। এর কারণ, ইনকা যোদ্ধারা অমিত শক্তির অধিকারী হতেন কিনোয়া খেয়ে, এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন ইনকাদের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিনোয়ার পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছেন। আধুনিক যুগে এই সুপারফুডের প্রচলন এতটাই সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় মনে করা হয় যে ২০১৩ সালটিকে আন্তর্জাতিক কিনোয়া বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।

কিনোয়ার পুষ্টিমান আসলে বলে শেষ করার নয়। যে ব্যাপারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, কিনোয়া একটি অত্যন্ত উচ্চ প্রোটিনসম্পন্ন খাবার। এক কাপ কিনোয়ায় ৮ থেকে ১০ গ্রাম পর্যন্ত প্রোটিন পাওয়া যায়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, কিনোয়া হচ্ছে একমাত্র উদ্ভিজ্জ প্রোটিন উৎস, যাতে ৯ ধরনের এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিড উপস্থিত আছে। বিশেষত লাইসিন নামের অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড আর কোনো উদ্ভিজ্জ আমিষ খাদ্য থেকে সেভাবে পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য, অ্যামিনো অ্যাসিডই হচ্ছে প্রোটিন গঠনকারী রাসায়নিক উপাদান। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিনোয়া একটি অত্যন্ত উচ্চমানের ও সম্পূর্ণ আমিষজাতীয় খাদ্য। তাই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের অপুষ্টি ও প্রোটিনের অভাব দূর করতে কিনোয়া অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

গ্লুটেন ফ্রি, লো-কার্ব, উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ কিনোয়ায় ক্যালরি একেবারে কম না হলেও (১ কাপে ২২০ কেক্যাল) এই ক্যালরি উপকারী বিভিন্নভাবে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণ করতেও কিনোয়া অত্যন্ত কার্যকর। আবার প্রচুর আঁশযুক্ত কিনোয়া খুবই নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত। অর্থাৎ এটি রক্তে দ্রুত শর্করা শোষণ ঘটায় না। এ কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিনোয়া খুব ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, কিনোয়ার বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ এনজাইমও ডায়াবেটিস কমিয়ে আনতে পারে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর