• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর
সর্বশেষ:
বকশীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রারের উপর হামলা: একজন গ্রেপ্তার রৌমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এর বিরুদ্ধে মানববন্ধন ইসলামপুরে কৃষকরা পেল উন্নত মানের বীজ কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে ভুটানের রাজা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৎপর হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতি : স্পিকার ভারতের কাছে পাঁচটি খাদ্যপণ্যের নিশ্চিত সরবরাহ চায় বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-অফিসিয়াল যোগাযোগ বাড়াতে প্রস্তুত বাংলাদেশ হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাস বিকৃত করা হয়

বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধনের পথে সরকার

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৩ মে ২০২২  

করোনা মাহামারির দুই বছরের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে বহুমুখী সংকটের মুখে পড়েছে সারা বিশ্ব। বৈশ্বিক ঝুঁকির এই প্রভাব মোকাবিলায় অর্থব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনের পথে হাঁটা শুরু করেছে সরকার।

এরই অংশ হিসাবে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বৃহস্পতিবার এক আদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিদেশ সফরসংক্রান্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কমপক্ষে দুইশ ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছে।

শুধু তাই নয়, কাতারে একটি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৭০ জনের একটি সফর কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নতুন রাস্তা নির্মাণের বিপরীতে বিদ্যমান রাস্তা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমদানিনির্ভর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ স্থগিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের আয় ও ব্যয়ের অবস্থা নাজুক পর্যায়ে। তাই অর্থব্যয়ে রক্ষণশীলতার মধ্য দিয়ে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে।

এ মুহূর্তে মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। এতে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। অপরদিকে রেমিট্যান্স প্রভাবে ঘাটতি চলছে। ফলে বহিঃবাণিজ্যে বাংলাদেশের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েই চলেছে।

চাপ পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দামও। এ কারণেই রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারে আরও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে সরকার। এদিকে বাংলাদেশের বৈশ্বিক ঝুঁকিগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বুধবার ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ এবং কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া হবে।

রিজার্ভ ব্যবহারেও আরও সকর্তা অবলম্বন করা হবে। বিশ্বের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। বিশ্বের যে সামগ্রিক অবস্থা, তা বিবেচনায় নিয়ে এসব সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

এর একদিনের মাথায় বৃহস্পতিবার সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ সফরের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরিপত্র জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, সব ধরনের এক্সপোজার ভিজিট, শিক্ষা সফর, এপিএ ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং কর্মশালা ও সেমিনারসহ সব ধরনের বিদেশ সফর বন্ধ থাকবে।

পরিপত্রে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনৈতিক পনুরুদ্ধার এবং বর্তমান বৈশ্বিক সংকট প্রেক্ষাপটে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে। এ আদেশ উন্নয়ন ও পরিচালনা বাজেট উভয় ক্ষেত্রে কার্যকর হবে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিদেশ সফর সংক্রান্ত তার ফাইলটি ফেরত এসেছে। তার মতে, আরও কমপক্ষে ২০০ কর্মকর্তার ফাইলও ফেরত এসেছে।

এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের। ওই তালিকায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে কর্মকর্তাও আছেন। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বাজেটে ২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে ভ্রমণ খাতে। বৈদেশিক মুদ্রায় ২৩ কোটি মার্কিন ডলার।

বর্তমান ভ্রমণ ব্যয়ে ৫০ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে এমন একটি বিধান রয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার অর্থ বিভাগের জারি করা পরিপত্রে সব ধরনের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঢালাও বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়েছিল। বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবিলায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ সফর, নতুন গাড়িসহ বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

বাজেটের ঘাটতি সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব হবে। বর্তমান রিজার্ভ কমছে। নতুন সড়ক নির্মাণ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি। কারণ প্রতি একনেকে নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দের অভাবে কাজ শুরু করা যায় না। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুরোনো প্রকল্পের বরাদ্দ ঠিক রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের আয় ও ব্যয় নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে। আয়ের অবস্থা খুব দুর্বল। এক ধরনের আর্থিক টানপোড়েনর মধ্যে পড়েছে। অর্থ আদায়ের দিক থেকেও ভালো হচ্ছে না। ফলে সরকার এক ধরনের রক্ষণশীলতার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে। ফলে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না। গত অর্থবছরে সর্বোচ্চ আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৬ হাজার ৫৫৯ কোটি ডলার, এবার ৯ মাসেই এই ব্যয় হয়ে গেছে।

এভাবে চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি ডলারে। এখন মাত্র ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা মজুত আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।

অপরদিকে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। বিপুল আমদানি ব্যয় ও নিুমুখী প্রবাসী আয়ের প্রভাবে অর্থবছরের ৯ মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০৭ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল সাড়ে ৫৫ কোটি ডলার।

দেশের ইতিহাসে চলতি আয়ে এত বড় ঘাটতি আর কখনো হয়নি। চলতি হিসাবে ঘাটতি মানেই সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম, ব্যয় অনেক বেশি। আয় ও ব্যয়ের এই ভারসাম্যহীনতাই ডলারের দাম বাড়াচ্ছে।

যে কারণে রিজার্ভের অর্থ ব্যয়ে আরও কৃচ্ছ সাধনের অংশ হিসাবে এলসি খোলার ওপর ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ করে দিয়েছে। যদিও এর আগে এটি ২৫ শতাংশ আরোপ করা হয়।

বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কারণে তার শাখার কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এতে অনেকে পণ্য আমদানি বন্ধ রাখবে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুটি বড় চ্যালেঞ্জ এখন সরকারের। প্রথম, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি মাসের পর মাস বেড়ে যাচ্ছে।

এতে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জোগান কম। ফলে মুদ্রাবাজারে বিশেষ করে খোলাবাজারে বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।

এতে ধীরে ধীরে রিজার্ভ ফুরিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের জোগান দিতে গিয়ে মাত্র ৫ মাসের আমদানি বিল পরিশোধের রিজার্ভ আছে।

পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতিতে এক ধরনের উভয় সংকটে পড়েছে সরকার। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মুদ্রা বিনিময় হার সমন্বয় করা হলে ডলারের দাম কিছুটা বাড়বে, যা বিলাসী পণ্য ও কম প্রয়োজনীয় পণ্য নিরুৎসাহিত হবে।

আবার ডলারের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও তা করা উচিত। কারণ, ৬-৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপ গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর পড়বে। সরকার তাদের জন্য নগদ সহায়তা প্রদানসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর ভাতা বাড়াতে পারে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর