• শুক্রবার ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ||

  • অগ্রহায়ণ ১৬ ১৪৩০

  • || ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

বশেমুরবিপ্রবিতে গাছে ধরে ‘লিপস্টিক’, যেন আদিকালের দৃশ্যপট

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০২৩  

প্রিয়তমার একপাটি লিপস্টিক মাখানো ঠোঁট যেকোনো প্রেমিকের মনে ভালোবাসার ঢেউ উদ্বেলিত করে। কোন বিশেষ মুহূর্ত বা বিশেষ দিন কিংবা উৎসব, লিপস্টিক যেন মেয়েদের সৌন্দর্যে অনন্য মাত্রা যোগ করে। স্রষ্টার নিখুঁত সৃষ্টিতে নতুন করে সহযোজন করে রঞ্জনের রক্তিমা। পারিবারিক বাঁধা, সামাজিক বাধা কিংবা ধর্মীয় বাধা-নিষেধ কামাতে পারেনি লিপস্টিকের ব্যবহার। শৈল্পিক বিল্পবের সময়কালীন ১৮৮০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রচলিত লিপস্টিকের ব্যবহার শুরু হলেও অতীতে এর ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নির্ভর। 
সুমেরীয় সভ্যতা থেকে মিশরীয় সভ্যতা, এরপর রোমান সভ্যতা- নারী এবং পুরুষ উভয়ই ঠোঁট রাঙাতে ব্যবহার করেছে বেরি বা জাম জাতীয় ফল, পান পাতা, লাল সীসা, মাটি, মেহেদি, বিভিন্ন পোকামাকড়, গাছগাছড়া কিংবা বিভিন্ন খনিজ। এসবের মধ্যে অন্যতম সুপরিচিত ও শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত এক গাছের নাম ‘লিপস্টিক গাছ’। এই বিরল প্রজাতির এই গাছ সংরক্ষিত রয়েছে দেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ উদ্ভিদ সংগ্রহশালা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি)।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রশাসনিক ভবন সংলগ্নে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল কমপ্লেক্সে এক পাশে দেখা মিলবে দুর্লভ এই গাছ। চিরহরিৎ গাছটির যৌগিক পত্রের সমন্বয়, সাদা পাপড়ির লাল পুষ্পমঞ্জরির ক্ষুদ্রকায় ফুল আর লালচে কোমল কাটা যুক্ত ফল বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যে অকৃত্রিম সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের সময়কালে উপাচার্যের বাসভবনে, প্রধান ফটকের বাইরে ও ভেতরে মোট তিনটি লিপস্টিক গাছ লাগানো হয়। তবে নানা কারণে বাকি দুটি গাছ মারা গেলেও, নিপুণ শোভা নিয়ে ৭ বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছে এই গাছটি। ২০১৯ সাল থেকে চারা থেকে পরিপূর্ণ গাছে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফুল থেকে শুরু করে চলে পরিপক্ব ফল হওয়ার জীবনচক্র।

বিরল এই গাছটি দেশের বৃক্ষের তালিকায় নতুন সম্ভাবনা বলে মনে করেন বশেমুরবিপ্রবির উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. নাহমিনা বেগম। তিনি বলেন, লিপস্টিক এই গাছটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কসমেটিকস শিল্পের বহুল পরিচিত একটি গাছ। এই গাছটি সংরক্ষণ ও বিস্তারের মাধ্যমে আমাদের দেশেও সম্ভাবনাময় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই গাছটিও যেন বিশ্ববিদ্যালয়েও সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে সবার সুদৃষ্টি রাখা উচিত। 

লিপস্টিক গাছের ইতিহাস:
লিপস্টিক গাছ বহির্বিশ্বে অ্যাচিওট গাছ, গাছ নামে সমাদৃত। এর বৈজ্ঞানিক নাম বিক্সা ওরেলানা। ল্যাটিন আমেরিকা সবচেয়ে বেশি এই গাছের দেখা মেলে। এর একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যা লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ানের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৬ শতকে স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের আগমনের সঙ্গে, অ্যাচিওট বিশ্বের বাকি অংশে পরিচিত হয়ে দ্রুত ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যান্য অংশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করা হয় যে এটি দক্ষিণ আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল এবং মায়ান এবং অ্যাজটেক সভ্যতা দ্বারা চাষ করা হয়েছিল। এছাড়াও শিল্প বিল্পবের প্রারম্ভে টেক্সটাইল ও বডি পেইন্টের জন্য প্রাকৃতিক রঞ্জক হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। 

প্রাচীনকাল থেকে লিপস্টিপ হিসেবে গাছটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহৃত হতো। সেখান থেকেই গাছটির নাম লিপস্টিক হয়। 

উপকারিতা:
লিপস্টিক গাছ পূর্বের মতো এখনো বিভিন্ন লিপস্টিক কোম্পানিতে মূল্যবান লিপস্টিকে প্রাকৃতিক রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি তেল, নেইল পালিশ ও সাবন এর উজ্জ্বল কমলা রং আর সুঘ্রাণ তৈরির জন্যও গাছটি বেশ পরিচিত। এছাড়া এটি ফিলিপাইনে ঐতিহ্যবাহী খাবার অ্যাডোবো এবং আফ্রিকায় এটি স্টু স্যুপে ব্যবহার করা হয়। 

এর স্বাতন্ত্র্যসূচক গন্ধ এবং প্রাণবন্ত রং হিসেবে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে জনপ্রিয় খাদ্যপযোগী রং হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে আছে শতাব্দীর পরে শতাব্দী। বিশেষ করে ম্যাক্সিকোতে জনপ্রিয় মুরগির গ্রিলকে লাল করতে এটি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও প্রাক-কলম্বিয়ান যুগে ঔষধি গুণাবলীর জন্য দেশীয় সংস্কৃতির অত্যন্ত মূল্যবান গাছ হিসেবে গাছটি বেশ পরিচিত ছিল। সে সময়ে জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য এটি ব্যবহৃত হতো। লিপস্টিক গাছে বিক্সিন এবং নরবিক্সিনের মতো যৌগ রয়েছে যার মধ্যে প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি শরীরের প্রদাহ কমাতে এবং আর্থ্রাইটিসের মতো অবস্থার লক্ষণগুলি উপশম করতে সহায়তা করে। গাছটি ঐতিহ্যগতভাবে হজম ও পেট ফাঁপা এবং ডায়রিয়ার মতো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যাগুলি দূর করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

এছাড়া এটি অন্ত্রে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে লিপস্টিক তেল ঐতিহ্যগতভাবে ল্যাটিন আমেরিকায় ত্বকের জন্য প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন এবং ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে যা ত্বককে রক্ষা করতে এবং পুষ্টি জোগাতে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে এটি  ভিটামিন ই, ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়াম সহ বেশ কয়েকটি পুষ্টির একটি ভালো উৎস। এর পুষ্টিগুণ শরীরের ইমিউন ফাংশন, হাড়ের স্বাস্থ্য এবং ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর