• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর
সর্বশেষ:
আমাদের সকল প্রাপ্তির দ্বার উন্মোচন করে গেছে মুজিব নগর সরকার অস্ট্রেড কমিশনার মনিকা কেনেডিকে ইউসিবি বাংলাদেশের অভ্যর্থনা ইসলামপুরে হিট স্ট্রোকে ব্যবসায়ীর মৃত্যু হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে যে নির্দেশনাগুলো দিলো স্বাস্থ্য অধিদফতর বাংলাদেশ জলবায়ু উন্নয়ন অংশীদারিত্ব গঠন: প্রধানমন্ত্রী এক্সারসাইজ টাইগার লাইটনিং (টিএল)-২০২৪ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর থাইল্যান্ড সফরে সই হবে ৫ চুক্তি ও সমঝোতা বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের তাগিদ আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি: শেখ হাসিনা যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব বাঁচত

মাটির নিচে এক নগর, ধ্বংসাবশেষে হারানো সভ্যতা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৯ মে ২০২৩  

প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে হারানো সভ্যতার সন্ধান৷ যেখানে দাঁড়িয়ে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন এক নগরীকে৷ ইতিহাসকে কাছে থেকে দেখতে বা ছুঁয়ে দেখতে কার না মন চায়! এমনকি অনেকে রয়েছেন, যারা ভ্রমণকেই জীবন হিসেবে নিয়েছেন। এছাড়াও ঘুরে বেড়ানোটা প্রায় সবারই স্বপ্ন থাকে। কোথাও প্রাচীনত্বের কোনো আভাস পেলেই সেখানে ছুটে বেড়াতে সবাই ভালোবাসেন। মানবসভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস জানতে আমরা পৌঁছে যেতে পারি নিজের দেশ ছেড়েও অনেক দূরে। 
তেমনি প্রাচীন ইতিহাসের এক স্বাক্ষী হয়ে আছে বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থানগড়। যেখানে মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন এক জনপদ। আছে অপূর্ব দর্শনীয় অনেক স্থান। সেখানকার একেকটা নিদর্শন একেকটা গল্প।

ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, পশুরামের রাজপ্রাসাদ, জাহাজ ঘাটা, গোবিন্দ ভিটা, হযরত শাহ সুলতান বলখী (র:) এর মাজার শরীফ, বৈরাগি ভিটা, শীলাদেবীর ঘাট, গোকুল মেধ, শিবগঞ্জের ভাসুবিহারসহ আরো অনেক কিছু। একা কিংবা পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে মহাস্থানগড়ে এসে সময় কাটান দর্শনার্থীরা। তারা ছুঁয়ে দেখেন ইতিহাস। এছাড়াও যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠানসহ ছুটির দিনে সেখানে অনেক দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মহাস্থানগড়ের বিস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষ প্রায় আড়াই হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের একটি নীরব স্বাক্ষী। 

পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান এটি। যা প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্রবর্ধনের অংশ ছিল। পুণ্ড্রবর্ধন ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। এই পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর। পরবর্তী সময়ে এটি মহাস্থানগড় হিসেবে পরিচিত হয়। এটি বগুড়া শহরের ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিত তীরে অবস্থিত। সমগ্র বাংলার সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রাচীন এ দূর্গনগরী পর্যায়ক্রমে মাটি ও ইটের বেষ্টনী দিয়ে সুরক্ষিত। যা উত্তর-দক্ষিণে ১ হাজার ৫২৫ মিটার দীর্ঘ এবং পূর্ব পশ্চিমে ১ হাজার ৩৭০ মিটার প্রশস্ত ও সমতল ভূমি থেকে ৫ মিটার উঁচু। বেষ্টনী প্রাচীর ছাড়াও পূর্ব দিকে নদী ও অপর তিন দিকে গভীর পরিখা প্রাচীন এই নগরীর অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, কয়েক শতাব্দি পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল শাসকদের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু রাজাদের রাজধানী ছিল। দূর্গের বাহিরে উত্তর পশ্চিম, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ৭-৮ কিলোমিটারের মধ্যে এখনো বিভিন্ন ধরনের বহু প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। যা উপ-শহরের স্বাক্ষ্য বহন করে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বলছে, বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হুয়েন সাঙ ভারতবর্ষ ভ্রমণকালে (৬৩৯-৬৪৫) পুন্ড্রনগর পরিদর্শন করেন। প্রখ্যাত বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে মহাস্থানগড়ের ধ্বাংসাবশেষকে হুয়েন সাঙ বর্ণিত পুন্ড্রনগর হিসাবে সঠিকভাবে সনাক্ত করেন।

১৯২৮-২৯ সালে মহাস্থানগড়ে সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কার্য শুরু হয়। এ সময় নগরীর মধ্যে বৈরাগির ভিটা, মুনীর ঘোন ও বাইরে গোবিন্দ ভিটা নামক তিনটি স্থানে খনন করা হয়। এর দীর্ঘদিন পর ১৯৬০-৬১ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে থেকে শুরু করে নিয়মিতভাবে দূর্গের বিভিন্ন অংশ উৎখনন করা হয়। তবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব দুর্গ প্রাচীরের মধ্যবর্তী এলাকায় খনন করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০০ সাল থেকে মাজারের পাশে খনন কাজ শুরু করা হয়।

দীর্ঘ সময়ব্যাপী ব্যাপক অনুসন্ধান ও খননের ফলে দূর্গ নগরীর ভেতরে খ্রিস্ট পূর্ব চতুর্থ শতক থেকে শুরু করে মুসলিম যুগ পর্যন্ত প্রায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে বসতি নিদর্শন উম্মোচিত হয়েছে। ১৮ টি স্তরে প্রাক মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও মুসলিম যুগের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি রাস্তা, নর্দমা নালা, কূপ, মসজিদ, মন্দির, তোরণ, বুরুজ, ইত্যাদি উম্মোচিত হয়েছে। এসব স্থাবর স্থাপতিক কাঠামো ছাড়াও বের হয়েছে তৎকালীন নগর জীবনের বিভিন্ন অস্থাবর সাংস্কৃতিক দ্রব্যাদিও। 

মহাস্থানগড়ে মাহী সওয়ার ও রাজা পরশুরাম 
সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন গৌড়ের রাজা থাকার সময়ে মহাস্থানগড় অরক্ষিত ছিল। ওই সময় মহাস্থানগড়ের রাজা ছিলেন নল। কিন্তু তার ভাই নীলের সঙ্গে তার বিরোধ লেগেই থাকতো। সেসময় এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এই এলাকায় আসেন। তিনি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র থেকে মহাস্থানগড়ে আসেন। তিনি পরশু বা কুঠার দিয়ে নিজের মাকে হত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। তিনি এই দুই ভাইয়ের বিরোধ মেটানোর নাম করে কৌশলে নিজেই রাজা বনে যান। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম হিসেবে পরিচিত হলেও তার আসল নাম রাম।

পরশুরাম রাজা হওয়ার পর অত্যাচারী শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। তখন সেখানে একজন আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশের আগমন ঘটে। তার নাম হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.)।  তিনি মাছ আকৃতির নৌকা অথবা মাছের পিঠে করে করতোয়া নদী পার হয়ে মহাস্থানগড়ে আসেন। মাছের পিঠে নদী পার হওয়ায় তাকে মাহী সাওয়ার (মাছের পিঠে আরোহণকারী) বলা হয়। 

তিনি আফগানিস্তানের বলখী নগর থেকে মহাস্থানগড়ে এসেছিলেন। তার সঙ্গে অনেক  অনুসারীও আসেন ওই সময়। মহাস্থানগড়ে এসে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তখনই স্থানীয় রাজা পরশুরামের সঙ্গে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হন।

কথিত আছে, জিয়ত কুণ্ড নামে একটি কূপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে উঠতেন। তাই হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.) একটি ঈগলের মাধ্যমে ওই কূপে একটি মাংসের টুকরো ফেলেন। আর তাতেই কূপের পানি আশ্চর্য গুণ হারিয়ে ফেলে। এর এতেই পরশুরাম যুদ্ধে পরাজিত হন। 

বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বা গোকুল মেধ
ঐতিহাসিকদের মতে, গোকুল মেধ মূলত একটি বৌদ্ধ মঠ। সম্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। 

কথিত আছে, এটি বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর। চাঁদ সওদাগর তার ছেলে লখিন্দরকে দেবী মনসার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এখানকার একটি গোপন কুঠুরিতে বন্ধ করে রাখেন। বিয়ের রাতে বা বাসর ঘরে বেহুলা এবং লখিন্দর গোপন কুঠুরিতে অবস্থান করছিলেন। এরপরেও সেখানে মনসার পাঠানো সাপ প্রবেশ করে লখিন্দরকে দংশন করে।

শীলাদেবীর ঘাট
মহাস্থানগড়ের করতোয়া নদীর তীরে  অবস্থিত শীলাদেবীর ঘাট। রাজা পরশুরামের বোন ছিলেন শীলাদেবী। কথিত আছে, রাজা পরশুরাম হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র)-এর কাছে পরাজিত হলে শীলাদেবী এ স্থানে আত্মহত্যা করেন। এখনো প্রতি বছর অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্ত এখানে পূজা দেন এবং স্নান করেন।

ভাসুবিহার
ভাসুবিহার স্থানীয়ভাবে নরপতির ধাপ নামে পরিচিত। এখানে বৌদ্ধ সংঘারামের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটি একটি বৌদ্ধ ধর্মপীঠ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

মাজার শরীফ
মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু পশ্চিমে হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এর মাজার শরীফ অবস্থিত। লোককথা অনুযায়ী, মাছের পিঠে আরোহণ করে তিনি বরেন্দ্র ভূমিতে আসেন। তাই তাকে মাহী সওয়ার বলা হয়। 

কালীদহ সাগর
মহাস্থানগড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং পদ্মাদেবীর বাসভবন। 

মিউজিয়াম
মহাস্থানগড় খননের ফলে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন যুগের বিভিন্ন নিদর্শনসহ অনেক দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। যেগুলো গড়ের উত্তরে অবস্থিত জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর