• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

ঘুরে আসুন বান্দরবানের নাফাখুম জলপ্রপাত

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

পানি প্রবাহের পরিমানের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলপ্রপাত হিসেবে আখ্যায়িত নাফাখুম জলপ্রপাত। বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত এই জলপ্রপাত। অনেকেই এই জলপ্রপাতকে বাংলার নায়াগ্রা বলে অভিহিত করেন। 

 

নাফাখুম ভ্রমণের সময়

সারা বছরই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ নাফাখুম জলপ্রপাত দেখতে ছুটে যায়। তবে বর্ষায় প্রায়ই সাঙ্গু নদীর পানি প্রবাহ বিপদসীমার উপরে থাকলে প্রশাসন থেকে অনুমতি দেওয়া হয় না নাফাখুম যাওয়ার জন্যে। আবার শীতকালে নাফাখুমে পানি অনেকটাই কম থাকে। তাই সবচেয়ে আদর্শ সময় বর্ষার পর পর ও শীতকালের আগের সময়টুকু (সেপ্টেম্বর – নভেম্বর)। তবে যে সময়ই যান না কেন, এখানের প্রকৃতি আপনার ভালো লাগবেই। নাফাখুম ভ্রমণ আপনার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন।

 

 

কিভাবে যাবেন নাফাখুম

নাফাখুম যেতে আপনাকে বান্দরবান জেলা সদরেই আসতে হবে প্রথম। তারপর বান্দরবান থেকে থানচি, থানচি থেকে নৌকায় সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রি বাজার যেতে হবে, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নাফাখুম যেতে হবে।

 

ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এস. আলম, ইউনিক, হানিফ, শ্যামলি, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন ইত্যাদি পরিবহনের বাস বান্দারবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি এসব বাসের ভাড়া যথাক্রমে নন এসি ৫৫০-৬৫০ টাকা ও এসি ৯৫০-১৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্রগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বান্দরবান যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে প্রতিদিনই সোনার বাংলা, সুবর্ণ, মহানগর ইত্যাদি ট্রেন চটগ্রাম যায়। শ্রেনী ভেদে ভাড়া ৩২০-১৫০০ টাকা।

 

চট্টগ্রামের বদ্দারহাট বাস স্টেশন থেকে বান্দরবানে যেতে পারবেন। পূবালী ও পূর্বানী নামের দুটি বাদ বান্দারবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ দুটি বাসে জনপ্রতি ২২০ টাকা ভাড়া লাগে। এছাড়া ধামপাড়া বাস স্টপেজ থেকে বান্দরবান যাওয়া যায়। চাইলে রেন্ট এ কারে করেও চট্রগ্রাম থেকে বান্দরবান যেতে পারবেন, মাইক্রোবাসের ভাড়া ২,৫০০-৩,৫০০ টাকা। উল্লেখিত ভাড়াগুলো কম-বেশি হতে পারে।

 

বান্দরবান থেকে থানচি

বান্দরবান থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭৯ কিলোমিটার। বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়া যায় দুইভাবে; বাসে কিংবা রিজার্ভ জীপে। বান্দরবানের থানচি বাস স্ট্যান্ড থেকে এক ঘণ্টা পর পর লোকাল বাস থানচির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি বাস ভাড়া ২০০ টাকা, সময় লাগবে ৪-৫ ঘন্টা। রিজার্ভ জীপ/চান্দের গাড়িতে গেলে খরচ হবে ৫,৫০০-৬,০০০ টাকা, সময় লাগবে ৩-৩.৫ ঘন্টা। এক গাড়িতে ১২-১৪ জন অনায়াসে যাওয়া যায়। থানচি যাওয়ার সময় পথে পরবে মিলনছড়ি, চিম্বুক ও নীলগিরি। চারপাশের অপুর্ব ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে দীর্ঘ পাহাড়ি পথের এই ভ্রমণ আপনার চোখ ও মনকে সতেজ করে রাখবে।

 

থানচি থেকে রেমাক্রি

থানচি পৌঁছে আপনাকে অবশ্যই একজন গাইড ঠিক করতে হবে। গাইড ছাড়া নাফাখুম ভ্রমণে যেতে পারবেন না। উপজেলা প্রসাশন থেকে অনুমতি পাওয়া যে কাউকে গাইড হিসেবে নিতে পারবেন। সাথে গিয়ে পরদিন থানচি ফিরে আসা পর্যন্ত গাইড ফি ১৫০০টাকা। গাইড ঠিক করার ব্যাপারটা আপনি থানচি গিয়েও করতে পারবেন অথবা আগে থেকে পরিচিত কোন গাইডকে কথা বলে ঠিক করে রাখতে পারেন। গাইড ঠিক করার পর আপনাকে থানচি বিজিবি ক্যাম্প/থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে। ভ্রমণকারী সকল সদস্যের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, কোথায় যাবে, কয়দিন থাকবে এইসব তথ্য কাগজে লিখে জমা দিতে হবে। আর এইসব কাজে আপনার গাইড সাহায্য করবে। আর মনে রাখবেন বিকেল ৩ টার পর থানচি থেকে রেমাক্রি যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না। তাই সেইদিনই রেমাক্রি যেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ২টার মধ্যে থানচি থাকতে হবে। তা না হলে ঐদিন থানচি থেকে পরদিন সকালে রেমাক্রি যেতে হবে। এতে করে আপনার একদিন বেশি সময় লাগবে।

 

অনুমতি পাওয়ার পর থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করতে হবে। এক নৌকায় ৪-৫ জন যেতে পারবেন। রেমাক্রি পর্যন্ত নৌকা রিজার্ভ যাওয়া ও পরদিন আসা সহ ভাড়া ৪,০০০-৫,০০০ টাকা। যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। সাঙ্গুতে পানি কম থাকলে কিছু জায়গায় নৌকা থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে তখন সময় একটু বেশি লাগতে পারে। যাবার পথে সাঙ্গু নদীর রূপ আপনাকে বিমোহিত করে রাখবে। এছাড়া পথেই পরবে পদ্মমুখ, ভূ-স্বর্গ খ্যাত তিন্দু, রাজাপাথর বড়পাথর এলাকা ও রেমাক্রি ফলস। আর গাইড এর যাওয়া, থাকা খাওয়া ও অন্যান্য খরচ আপনাকে বহন করতে হবে। 

 

রেমাক্রীতে রয়েছে মারমা বসতি, মারমা ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। রেমাক্রী থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা পায়ে হাটলে তবেই দেখা মিলে প্রকৃতির এই অনিন্দ্য রহস্যের। রেমাক্রী খালের পানি নাফাখুমে এসে বাক খেয়ে প্রায় ২৫-৩০ ফুট নিচের দিকে নেমে গিয়ে প্রকৃতি জন্ম দিয়েছে এই জলপ্রপাতের।

 

রেমাক্রি থেকে নাফাখুম

সাধারণত খুব সকালে বান্দরবান থেকে রওনা দিলে রেমাক্রি পৌছাতে বিকেল হয়ে যায়। সেইদিন আর নাফাখুম যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। সেই রাত রেমাক্রি বাজারে থেকে পরদিন সকালে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। রেমাক্রি থেকে আপনাকে স্থানীয় আরও একজন গাইড ৫০০ টাকা দিয়ে নিতে হবে। থানচি থেকে আসা গাইডই ঠিক করবে। রেমাক্রি থেকে রেমাক্রি খাল ধরে হেঁটে নাফাখুম যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘন্টা। তবে সময় কত লাগবে তা নির্ভর করবে ভ্রমণকারী সঙ্গীদের হাঁটার গতির উপর আর কোন সময়ে যাচ্ছেন তার উপর। বর্ষায় রেমাক্রি খালে পানি অনেক বেশি থাকে। কোথাও কোমর পানি কিংবা কোথাও আরও বেশি। কিছু জায়গায় রেমাক্রি খাল এপার ওপার করতে হবে। পানি বেশি থাকলে এই পারাপারে সময় বেশি লাগবে। চিন্তার কিছু নেই, এইসব জায়গায় আপনার গাইড আপনাকে সাহায্য করবে। রেমাক্রি খাল ও তার চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই একসময় আপনি নাফাখুম জলপ্রপাতের গর্জন শুনতে পাবেন।

 

নাফাখুম ভ্রমণে কোথায় থাকবেন?

থানচি ভালো কোথাও থাকতে চাইলে বিজিবি নিয়ন্ত্রিত সীমান্ত অবকাশ কেন্দ্রে থাকতে পারবেন। রুম ভাড়া ১৫০০-৩০০০ টাকা এর মধ্যে। এছাড়া থানচি বাজার ও আশেপাশে কিছু কটেজ ও রেস্টহাউজ ধরণের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা আছে। মান অনুযায়ী দিন প্রতি ভাড়া ২০০-১০০০ টাকার মধ্যে। রেমাক্রি বাজারে আদিবাসীদের ঘরে থাকার ব্যবস্থা আছে। সাঙ্গু নদীর পাশে আদিবাসীদের রেস্ট হাউজে কয়েকজন মিলে থাকতে হলে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ১৫০ টাকা।

 

খাবেন কোথায়

থানচি বাজারে মোটামুটি মানের কিছু খাওয়ার হোটেল আছে। কোন একটায় খেয়ে নিতে পারবেন। রেমাক্রিতে আদিবাসী বাড়িতেই খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আগে থেকে বলে রাখলেই হবে। অনেকটা প্যাকেজ সিস্টেমে খাওয়ার ব্যবস্থা। সাধারণত ভাত, ভর্তা, ভাজি ও ডিম খেতে খরচ হবে ৮০ টাকা, ডিমের বদলে মুরগি খেতে চাইলে খরচ হবে ১২০ টাকা। আগে থেকেই গাইডকে দিয়ে জানিয়ে রাখবেন কি খাবেন ও কতজন খাবেন। আগেই বলেছি টাকা খরচ কম-বেশি হতে পারে।

 

নাফাখুম ট্যুর প্ল্যান

যেখানেই থাকেন চেষ্টা করবেন সকালেই বান্দরবান চলে আসার। ঢাকা থেকে রাত ৯-১০ টার বাসে রওনা দিয়ে সকালে বান্দরবান। বান্দরবান সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে লোকাল বাস বা জীপে করে থানচি চলে যাওয়া। অনুমতি ও অন্যান্য কাজ সেরে নৌকায় করে রেমাক্রী বাজার চলে যাওয়া। রাতে রেমাক্রি বাজারে থেকে পরদিন সকালে নাফাকুম ঘুরে দুপুরের মাঝে রেমাক্রী ফেরত আসা। দুপুরে খেয়ে সময় নষ্ট না করে রেমাক্রি থেকে নৌকায় থানচী বাজার চলে আসা। থানচি থেকে বাস/জীপে সন্ধ্যায় বান্দরবান পৌঁছে কিছু খাওয়া দাওয়া করে রাতের বাসে ঢাকা অথবা আপনার গন্তব্যে রওনা হওয়া।

 

দ্রুত গতিতে নেমে আসা পানির জলীয় বাষ্পে সূর্য্যের আলোয় প্রতিনিয়ত এখানে রংধনু খেলা করে। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হন ও বান্দরবানে ট্রেকিং করার ইচ্ছে থাকে, কিংবা দেখতে চান বান্দরবানের গহীনের সবুজের খেলা, আদিবাসীদের জীবন চিত্র, সাঙ্গুর ভয়ংকর রূপ বা শীতের টলমলে পাথুরে জলের খেলা তবে আপনার জীবনে একবার হলেও যাওয়া উচিত অনিন্দ্য সুন্দর এই  ঝর্ণায়।

 

উপর হতে আছড়ে পড়া পানির আঘাতে ঝর্নার চারিদিকে সৃষ্টি হয় ঘন কুয়াশার। উড়ে যাওয়া জলকনা বাষ্পের সাথে ভেসে ভেসে শরীরে এসে পড়ে। রোমাঞ্চকর সে অনুভূতি।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর