• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে অজানা কথা প্রকাশ্যে আনলেন ড. মসিউর

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২২  


পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ ইস্যুতে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার চাপপ্রয়োগ নিয়ে মুখ খুললেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। তিনি বলেছেন, তার ওপর সরে যাওয়ার যেমন চাপ ছিল, তেমনি লোভনীয় প্রস্তাবও ছিল। সরে যাওয়ার শর্তে বিশ্বব্যাংক বা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। সেই সময় কিছু আওয়ামী লীগের নেতাও তাকে বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানান এই উপদেষ্টা।

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন-ক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ার পর এক দশক আগের সেই কথা গত শনিবার (২৮ মে) রাতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে আনলেন ড. মসিউর।

বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার অর্থায়নে ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর পর দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের চাপে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়, ছুটিতে যেতে হয় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইনকে। এ নিয়ে মামলাও হয়। কিন্তু এর পরও তারা অর্থায়নে ফিরে না এসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমানের পদত্যাগের শর্তও দেয় বিশ্বব্যাংক। কিন্তু তিনি রাজি হননি।


এরপর বিশ্বব্যাংক আর এই প্রকল্পে ফেরেনি। সরকারও বিদেশি অর্থায়ন থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যায় এবং কাজ শেষ করে। আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন পদ্মা সেতু।

শুক্রবার রাতে ভার্চুয়াল ওই অনুষ্ঠানে সেসব ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর।

তিনি বলেন, “এখানে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ছাড়া অন্য যারা অর্থায়ন করছে- বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা- এরা একদিন সকালে আগে সময় ঠিক করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলো। প্রথমে তারা বলল, জাপানের অ্যাম্বাসির অফিসে বাসার কথা।

তিনি বলেন, আমি বললাম, দেখো জাপান অ্যাম্বাসির অফিসে আমি যাব না। আমার নিজের কাছে যুক্তি ছিল যে, জাপানি অ্যাম্বাসির কাছে যদি আমি যাই, তাহলে যেটা মানুষের ধারণা হবে এবং প্রচার হবে- সেটা হলো, আমি বোধহয় তাদের কাছে নতজানু হয়ে কোনো একটা সুবিধা চাচ্ছি। জাপানি অ্যাম্বাসেডরকে বললাম, তুমি তাহলে আমার এখানে আসো। জাপানি অ্যাম্বাসেডর বলল- ‘না, তোমার ওখানে গেলে সাংবাদিকদের ফেস করতে হবে, আমি সাংবাদিকদের ফেস করতে পারব না’। আমি বললাম, সাংবাদিকদের আমি ফেস করব, তুমি আসো।”

মসিউর রহমান বলেন, “ওরা এসে আমাকে বলল, আমাকে দায়িত্ব ত্যাগ করতে হবে, দেশও ত্যাগ করতে হবে। দেশত্যাগের শর্ত হলো— তারা আমাকে বিদেশে বিশ্বব্যাংকে বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা কোথাও একটা কনসালট্যান্সি জোগাড় করে দিবে এবং আমি যে বেতন চাই, সেই বেতনই তারা ব্যবস্থা করে দেবে। অথবা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কিছু কাজ ঠিক করে দেবে এবং তারা আমাকে টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেবে। আমার উত্তর হলো দেখো, আমার যদি টাকা করার ইচ্ছা থাকত, তাহলে তোমরা যে দোষারোপ করছ, সেখানেই তো আমি টাকা করতে পারতাম। ওদের যেটা প্রস্তাব, এটা হলো একটা সামঞ্জস্যহীন প্রস্তাব। যে দোষ করেছে, তাকে আবার তারা পুরস্কৃত করবে।

সেসময় আওয়ামী লীগ নেতা ও বন্ধুরাও তাকে বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানান মসিউর।

তিনি বলেন, “যেটা আমার বলা উচিৎ হবে এবং না বলাটা অনুচিত হবে— এই শক্ত পজিশন নেওয়ার ক্ষমতাটা কোত্থেকে আসলো? বিশ্বব্যাংক বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কিছু গুরুজন স্থানীয়, যারা প্রভাবশালী, দু-একজন আমার বন্ধু, তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত- বন্ধু হিসেবে তারা আমাকে বলেছে যে, দ্যাখো তোমার নামে এসব ছড়াচ্ছে। তুমি কেন দায়িত্ব ত্যাগ করো না এবং দেশ ছাড়ো না কেন?

‘আমি বললাম, আমি দেশ ছাড়ব না— এইজন্য যে, দেশের বাইরে গেলে আমার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না’ বললেন ড. মসিউর।

‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহস জুগিয়েছেন’ এ কথা বলতে বলতেই লাইভ অনুষ্ঠানে আবেগাপ্লুত হয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি।

কান্নাজড়িতকণ্ঠে তিনি বলেন, “আমি যেটা বলি সেটা হলো, আমার ওপর একটা বড় ছায়া আছে। সেই ছায়াটা হল- বঙ্গবন্ধুর ছায়া। ওই ছায়া যতদিন থাকবে, ততদিন আমি নিরাপদ।”

মসিউর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও সৎ সাহস না থাকলে পদ্মা সেতু হতো না।

তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট শেষ কর্মদিবসে এই ঋণ বাতিল করে দেন। ঋণের অনুমোদন দেয় বিশ্বব্যাংকের বোর্ড। বোর্ডকে নাকচ করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের আছে কিনা, এই একটা প্রশ্ন থাকতে পারে।”

পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরু থেকেই এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এই উপদেষ্টা বলেন, “পদ্মা সেতু শুরু হওয়ার আগে বা এই দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক সোচ্চার হওয়ার আগে যেটা অনুসরণ করা হতো- যে সংস্থা ঋণ দিয়েছে, প্রত্যেকে তাদের নিজের নিজের নিয়ম মেনে চলতো।

কিন্তু এইখানে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকা এদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে, যদি বিশ্বব্যাংক কোথাও দুর্নীতির জন্য কোনো সহায়তা বন্ধ করে তাহলে এরাও সে সহায়তা বন্ধ করবে। এরকম চাপ তারা সৃষ্টি করলো। এই যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চাপ সৃষ্টি- এর বিরুদ্ধে একটা পজিশন নেওয়া, এটা অত্যন্ত সাহসী না হলে সম্ভব হতো না।”

পদ্মা সেতুর চালুর পর বাংলাদেশের উন্নয়ন কিভাবে ত্বরান্বিত হবে সে কথাও তুলে ধরেন তিনি।

মসিউর বলেন, “উন্নয়ন ততক্ষণ শুরু হয় না, যখন না মানুষের মনে উন্নয়ন স্পৃহা জাগে। দ্বিতীয়ত যতক্ষণ না তাদের এই আস্থা জাগে যে, উন্নয়ন শুধু স্বপ্ন না, উন্নয়ন তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে। আর এই বাস্তবায়ন সম্ভব হয় দেশের নেতৃত্ব ও নীতি যদি সঠিক পথে চলে। জনগণের আস্থা ও স্পৃহাই হলো সব থেকে বড় শক্তি। এই স্পৃহার এখনকার উৎস শেখ হাসিনা।”

বঙ্গবন্ধু সেতু যখন শুরু হয়, তখনও বিশ্বব্যাংক এটা ‘ভায়াবল’ হবে না বলে আপত্তি তুলেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো যখন অনেক উন্নতি হবে, তখন বিশ্বব্যাংক আবার নিজে থেকেই ফিরে আসল। বঙ্গবন্ধু সেতু জাতীয় আয়ে ২ থেকে ৪ শতাংশ অবদান রাখছে, যেটা সমীক্ষার থেকেও বেশি।

এমন সেতু আগামী ৫০ বা ১০০ বছরেও আর একটি হবে না মন্তব্য করে মসিউর বলেন, বিশ্বব্যাংক একটি শতবর্ষী প্রকল্পের অংশীদার হওয়া থেকে নিজেকে বাদ দিয়েছে। বাংলাদেশ এককভাবে এই শতবর্ষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এটা দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেবে। এইটা একটা বড় অর্জন।

পদ্মা সেতু নিয়ে যে ‘ষড়যন্ত্র’ সেটা ‘আপতদৃষ্টিতে’ কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

‘রাজনীতির সাতকাহন’ নামে আওয়ামী লীগের এ সাপ্তাহিক আয়োজনে সঞ্চালনা করেন দলের উপ-প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম; বক্তৃতা করেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর