• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

রাষ্ট্রপতির গাড়ি ব্যাতিত সেতুতে টোল ফ্রি সুবিধা বন্ধ হচ্ছে

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৩১ মার্চ ২০২৩  

সেতু তৈরিতে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। শুধু পদ্মা সেতুতেই ঋণের বোঝা ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এখন পর্যন্ত এ সেতুতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী টোল আদায় হচ্ছে না। কারণ যানবাহন চলাচল কম। এর বাইরে অনেক সেতুতেই দেশি-বিদেশি মাধ্যম থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। আছে সেতু পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও।

সে জন্য এবার ঋণের টাকা জোগাতে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। আগামী এপ্রিল মার্চ থেকে রাষ্ট্রপতির গাড়ি ব্যতীত অন্য কোনো যানবাহন বিনাটোলে চলাচল করতে দেবে না সংস্থাটি।

ইতিমধ্যে সরকারি সব দফতর ও সংস্থায় এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ, যা আগামী এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর করা হবে বলে সেতু কর্তৃপক্ষের ১১২তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এ বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মো. মনজুর হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, সেনাবাহিনীর অনেক গাড়ি ক্রেডিট টোলের আওতায় যাতায়াত করে থাকে। অন্যদের ক্ষেত্রেও এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অনেক গাড়ি বিনাটোলে যাতায়াত করে যা পরে ওই টোল আমাদের পরিশোধ করতে হয়। যেহেতু আমাদের ঋণের টাকা এ টোল আদায়ের মাধ্যমেই পরিশোধ করা হয় তাই আমরা এটা আর বাড়াতে চাচ্ছি না। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে রাষ্ট্রপ্রতির গাড়ি ছাড়া অন্য কারও গাড়ি বিনাটোলে যাতায়াত করতে দেওয়া হবে না। এটি আগামী এপ্রিল থেকেই কার্যকর করা হবে।

ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী সেতু কর্তৃপক্ষের ১১টি প্রকল্প চলমান। এরমধ্যে দুইটি প্রকল্পের ব্যয় তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া নেই। বাকি ৯টি প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ২২৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সম্প্রতি পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা বাড়ছে, যা এই তথ্যে যোগ করা হয়নি। এ ছাড়া প্রকল্পের এই ব্যয়ের সঙ্গে ঋণের সুদও যুক্ত হবে। ঋণের সুদসহ সেতু কর্তৃপক্ষের দেনা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে জানা গেছে। 

সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এই টাকা সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।     

৩৫ বছরের মধ্যে এই ঋণের সুদসহ সরকারকে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। নতুন করে সেতুর ব্যয় আরও ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ টাকাও সুদসহ সরকারকে ফেরত দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে।

সরকারের ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার একমাত্র উপায় টোল আদায়। অথচ পদ্মা সেতুতে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। গত প্রায় ৯ মাসে পদ্মা সেতুতে টোল আদায় হয়েছে মাত্র ৪১৪ কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭২০ টাকা। মাসে টোল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা । সে হিসাবে প্রায় ৯ মাসে টোল আদায় হওয়ার কথা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। টোল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় চাপে আছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

পদ্মা সেতু ছাড়াও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ৪ হাজার ৮৬৯ কোটি ৮ লাখ টাকা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট [সেতু কর্তৃপক্ষ অংশ]) প্রকল্পে ৯৩৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ১৬ হাজার ৯১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ঢাকা শহরে সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পে ২২৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কচুয়া-বেতাগী সড়কে পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ১ হাজার ৪২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে ২ হাজার ২৪২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এ ৯ প্রকল্পের ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হলেও ভুলতা-আড়াইহাজার-বাঞ্ছারামপুর সড়কে মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ ও সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ (এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ)-এর সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের ৩৪ কিলোমিটারের ব্যয়ের কোনো হিসাব দেওয়া হয়নি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, টোলের বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এটি খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। এতে ব্যক্তিগত যাতায়াতটা কমে যাবে। অনেকেই সুবিধা পাওয়ায় ব্যক্তিগত যাতায়াত করে থাকেন। তবে এর ফলে পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না, কিছুটা আয় বাড়বে। পদ্মা সেতুর টোলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দক্ষিণ অঞ্চলের অর্থনীতির পরিধি আরও বাড়াতে হবে। সেখানে শিল্প-কারখানার উত্তম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা হলে ওই অঞ্চলে যাতায়াত বাড়বে পদ্মা সেতুতে টোলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। তবে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচল শুরু হলে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। কারণ যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন তখন ট্রেনে বেড়ে যাবে। কারণ ট্রেনে পরিবহন সাশ্রয়ী। আর প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল দেবে ট্রেন। যাতায়াত যেমনই থাকুক রেলের ফি নির্দিষ্টই থাকবে। 

সব মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর ও সংস্থায় পাঠানো চিঠিতে সেতু কর্তৃপক্ষ বলে, সেতু কর্তৃপক্ষ একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব আয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু এবং মুক্তারপুর সেতু পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। এ ছাড়া, সেতু কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতাদি পরিশোধ, মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নসহ বিভিন্ন সমীক্ষা, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। এসব সেতু ও স্থাপনাগুলো নির্মাণে বিপুল দেশি ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহীত সব ঋণও সেতু কর্তৃপক্ষ সেতুর টোল আয় থেকে সুদে-আসলে সরকারকে পরিশোধ করে থাকে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সেতু বিভাগের সব স্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী তার গাড়িবহরের জন্য টোল তাৎক্ষণিক পরিশোধ করে থাকেন। অথচ সেতু কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, স্থাপনা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সংস্থা বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু এবং মুক্তারপুর সেতুতে বিনাটোলে যাতায়াত করে। এ টোলের টাকা পরে সেতু কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হয়। এতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। সেই সেঙ্গ ঋণ পরিশোধসহ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

গত ১৯ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেতু কর্তৃপক্ষের ১১২তম বোর্ড সভায় বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় সেতু কর্তৃপক্ষের আওতাধীন সব সেতু বা স্থাপনায় রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর ব্যতীত অন্যান্য সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের যানবাহনগুলোর টোলমুক্ত পারাপার সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু সেতু বা স্থাপনার ওঅ্যান্ডএম অপারেটরের যানবাহন এবং সংশ্লিষ্ট সেতু বা স্থাপনার নির্মাণকাজে নিয়োজিত ঠিকাদারের যানবাহনগুলো সেতু কর্তৃপক্ষ টোল পরিশোধসাপেক্ষে পারাপার করবে। 

এ ছাড়া সেতু বা স্থাপনায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস, রেকার, অ্যাম্বুলেন্স, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িসহ জরুরি পরিষেবার যানবাহন বিনাটোলে যাতায়াতের সংস্থান রাখা হবে। তবে বঙ্গবন্ধু সেতু এবং পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য স্থাপনায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব যানবাহনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যানবাহন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি বা লিখিত যোগাযোগের মাধ্যমে পরে টোল পরিশোধ করার শর্তে ক্রেডিট টোলের সুবিধা পেতে পারে। টোল অব্যাহতি প্রত্যাহারের সিন্ধান্তটি ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর