• রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২০ ১৪৩১

  • || ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

লাশের সঙ্গে আশরাফের ৪২ বছর!

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

১২ বছর আগের কথা। জামালপুরের ইসলামপুর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে একটি লাশ ভ্যান গাড়িতে তোলা হয়। ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। কিন্তু নিহতের বাড়িতে লাশ দ্রæত পৌঁছে দিতে হবে। 

আশরাফ জানায়,তাই বাধ্য হয়ে অন্ধকার রাতেই রওনা হতে হয়। ইসলামপুর জামালপুর মহাসড়কের কাঙ্গালকুর্শা এলাকায় আসতেই হঠাৎ পিছনে ঘোংড়ানোর শব্দ হয়।  ফিরে তাকাতেই কলিজাটা লাফ দিয়ে উঠে।  সাহস নিয়ে ভ্যানটা আবার টানা শুরু নিহতের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। 
প্রথমে ভূত ভেবে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই। সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। হাত-পা কাঁপতে থাকে। সামনে একটা দোকান দেখে ভ্যানগাড়ি থামিয়ে বসে পড়ি। বুকের মধ্যে ধুকধুক করছিল। ইসলামপুর পৌর শহরের নটারকান্দা গ্রামে মৃত-শহিদ শেখের ছেলে আশরাফ আলী। 
এই পেশায় কীভাবে আসলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,জন্মের পর থেকেই অভাব অনাটনের মধ্যে বড় হয়ে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে। হঠাৎ ভ্যান চালক ওস্তাদ আবু বক্করের সাথে পরিচয় হওয়ার সুবাধে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে ভয় করলেও জীবিকার তাগিদেই এই পেশায় জড়িয়ে পড়ি।
আশরাফ আরো জানায়, তার ওস্তাদ বক্কর প্রায় ৬০বছর লাশ টেনেছে। তারি সাথে জীবনের ৪২টি বছর অতিবাহিত করে আজো লাশ টানছে। তার ওস্তাদ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভয় পেয়ে মৃত্যু বরণ করেছে\ 
সে জানায় একদিন সন্ধ্যায় লাশ নিয়ে জামালপুর মর্গে রওনা হয় ওস্তাদ বক্কর। জামালপুর ইসলামপুর মহা সড়কে শ্যামপুর পথের মধ্যে হঠাৎ পিছন ফিরে তাকায় বক্কর। ফিরে তাকাতেই লাশটি বসে রয়েছে দেখেই ভ্যান ফেলে দৌড়ে পালায়। পরে প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখে তাকে আবার সাহস যুগিয়ে রওনা হতে বলে। তারপর থেকেই ওস্তাদ বক্কর বিছানা থেকে উঠে দাড়াতে পারেনি। অবশেষে মৃত্যু হয়েছে তার।
নিজের ও ওস্তাদের লাশবহন করা পেশার ৪২ বছরের দুটি ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই এ প্রতিবেদকের নিকট বলছিলেন আশরাফ আলী (৬০)।
বিচিত্র এই পেশায় এসে কম পক্ষে সহশ্রাধিক লাশ বহন করেছেন আশরাফ। লাশ বহন করতে এখন তার মনে ভয়-ডর নেই। গভীর রাতেও একাকী লাশ নিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে যান। ভ্যান চালানোর সময় বারবার পেছনে ফিরে দেখেন লাশটা ঠিক আছে তো।
আশরাফ জানান, উপজেলায় কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ইসলামপুর থানা থেকে ডাক পড়ে তার। এরপর ভ্যানগাড়ি নিয়ে লাশ উদ্ধার করার জন্য বেরিয়ে পড়েন তিনি। কখনো দড়িতে ঝোলানো বীভৎস লাশ, কখনো ক্ষত-বিক্ষত, কখনো পচা-গলা লাশ, কখনো আবার দেহের ছিন্নভিন্ন হাত-পা বা মাথার অংশ নির্ভয়ে ভ্যানে তুলে নেন। এরপর লাশ থানায় আনা, ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যাওয়া, আইনি সকল প্রক্রিয়া, সর্বশেষ নিহতের লাশ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটাও আশরাফ নিজেই করে থাকেন।
আশরাফ বলেন, ‘পরিচয়হীন হলে লাশের ময়নাতদন্ত ও বহনের জন্য তিন হাজার টাকা না হলে পুষে না। এ টাকা লাশের ওয়ারিশদের নিকট থেকে নিতে থাকি। মাঝে মাঝে উপার্জন ভালোই হয়। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পৌর শহরের স্টেশন এলাকায় আশরাফ আলীর বাড়ি। সেখানেই ছোট একটি ঘরে তার সংসার। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে রয়েছে। তবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় তাকে।
কারণ প্রতিদিনি তো আর লাশ মিলে না। আর লাশ না মিললে উপার্জন বন্ধ। তাছাড়া তার নেই সরকারি বেতন-ভাতা। ঈদ-নবান্ন-বৈশাখেও জোটে না সরকারের উৎসবভাতা। তাই প্রতিদিন লাশের খবরের জন্য ভ্যান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়। 
এদিকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক শক্তিও কমছে তার। আশরাফ বলেন, অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধ করে আমার সংসার চলে। যখন লাশ থাকে তখন আমার সংসার চলে। যখন লাশ থাকে না তখন ঘরে খাবারও জুটে না।
এতে আমার চলতে খুব কষ্ট হয়। তাই আমার চাকরিটা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে স্থায়ীকরণের জন্য পুলিশ বিভাগ ও সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। দয়া করে আমাদের দুঃখ-দুর্দশা একটু পত্রিকায় তুলে ধরেন।
ইসলামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুমন তালুকদার বলেন, আশরাফ শুধু লাশ বহন করে না, লাশ পাহারাও দেয়। লাশ নিয়ে আশরাফের অসংখ্য ঘটনা শুনলে ভৌতিক মনে হয়, যা সত্য। তবে সরকারী কোন ব্যবস্থা না থাকলেও আমরা পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা করে থাকি।
ইসলামপুর সহকারী পুলিশ সুপার অভিজিত দাস বলেন,প্রতিটি থানায় লাশ বহন করার জন্য একজন করে চালক থাকে। তবে পুলিশ বিভাগে তাদের চাকরি স্থায়ী করার সুযোগ নেই। তারপরও আশরাফের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।
 

দৈনিক জামালপুর