• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

নকশী বিওপির যুদ্ধ - জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার আরেকটি উদাহরণ

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০২১  

পাকিস্তানে শৈশব, কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত করা এদেশের স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের গুপ্তচর কিংবা "বাই চান্স মুক্তিযোদ্ধা" বললে তার সমর্থকরা আপত্তি তুলে থাকেন। 

অথচ বাংলাদেশের জন্য তার গ্রহণ করা প্রতিটি পদক্ষেপই কেন প্রশ্নবিদ্ধ বা বিতর্কিত তার জবাব কেউ দেন না। মহান মুক্তিযুদ্ধে দুটি সম্মুখ সমরে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়। এর একটি হচ্ছে - কামালপুরের যুদ্ধ যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য শহীদ হন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে নকশী বিওপির যুদ্ধ। এ দুটি সম্মুখ সমরে ব্যর্থতার কারণ জিয়াউর রহমানের আত্মঘাতী এবং/অথবা বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, এ দুটি ঘটনা কি কাকতালীয় হতে পারে? ৯ মাসের যুদ্ধে জিয়া সক্রিয় ছিলেন প্রায় দুই মাস। এ সময়ে একমাত্র জিয়ার ক্ষেত্রেই কেন পরপর দু'বার ব্যর্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়? দু'বারই তিনি যুদ্ধের অপরিপক্ক নির্দেশ দিয়ে সীমান্তের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।

নকশী বিওপি যুদ্ধঃ

১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই ময়মনসিংহের কামালপুরের যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছাকৃত বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে ৬৭ জন শহীদ হন। কিন্তু এর এক মাস পর ৩ আগস্ট, ১৯৭১ ময়মনসিংহের ঝিনাইগাতির (বর্তমানে শেরপুর) নকশী বিওপিতে একই প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত দেন জিয়া। মাত্র ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ৮ ইস্টবেঙ্গলের কমান্ডার মেজর এ জে এম আমিনুল হককে আক্রমণের নির্দেশ দেন জিয়া। মূল আক্রমণ পরিচালনার জন্য ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

আক্রমণের আগে রেকি ও অনুসন্ধান করেই জানা গিয়েছিল যে হালকা ও ভারী অস্ত্রসহ পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জন এবং তাদের সহযোগী রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৬০/৭০ জন। এ অবস্থায় কামালপুরের যুদ্ধ কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন জিয়া।

ফলাফল: 

নকশী বিওপির যুদ্ধে ২৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীসহ ৩৫ জন আহত হন। পরদিন ১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ বিকৃত করে ফেরত দেয় পাকিস্তানি বাহিনী।

বিশ্লেষণ:

নকশী বিওপির যুদ্ধ নিয়ে বিশ্লেষণের খুব বেশি সুযোগ নেই কারণ এতে কামালপুর যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। তথাকথিত বিশ্লেষকরা জিয়ার সাফাই দিয়ে বলে থাকেন যে - ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের জন্য সহায়ক ছিল তাই আক্রমণ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ কথা বলেন না যে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে স্থানীয় ৬০/৭০ জন রাজাকারও যুদ্ধ করেছিল। তাই ভৌগোলিক অবস্থান উভয় পক্ষের জন্যই সমান ছিল। উপরন্তু পাকিস্তানি গেরিলাযোদ্ধারা ছিল উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর আমাদের ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিল মাত্র ১০ জন, ৮ জন ইপিআরের ও ২-৩ জন পুলিশের ছিলেন। বাকি সকলে ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা। তাই জিয়ার এ সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী ও হঠকারী ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানের মিশন ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া। ফলে জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা কমে যেতো। মুক্তিযুদ্ধে জিয়া দুই বার নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পান এবং দুই বারই তিনি আমাদের পরাজয় নিশ্চিত করেন। এর ফলাফল মারাত্মক হতে পারতো। সাধারণত যুদ্ধে পরাজিত করার সবচেয়ে বড় কৌশল মনোবল ধ্বংস করে দেয়া। কামালপুর ও নকশী বিওপির মতো আর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলে মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণের মনোবল ভেঙ্গে পড়ার কথা। অন্যদিকে দুই সম্মুখ সমরে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধি পায় যা রাজাকারের সংখ্যাও বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার আস্থাভাজন জিয়া বিতর্কিত ঘোষণার মাধ্যমে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছিল। বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের কারণেই মুক্তিযুদ্ধকালে জিয়াকে বরখাস্ত ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশও দিয়েছিলেন ওসমানী যা তাজউদ্দীন আহমেদ ও খন্দকার মোশতাকের কারণে কার্যকর করা হয় নি। ফলে তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। অন্যান্য কয়েকটি যুদ্ধের নেতৃত্ব জিয়ার উপর দেয়া হলে আমরা স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হতাম কিংবা মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতো। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। 

তথ্যসূত্র

১. মুক্তির জন্য যুদ্ধ: কর্নেল শাফায়াত জামিল বীরবিক্রম
২. এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: মে. জে. মইনুল হোসেন বীরবিক্রম
৩. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মে. রফিকুল ইসলাম
৪. যুদ্ধের ময়দান থেকে জিয়ার পলায়ন, সিরু বাঙালি 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর