• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

করোনা ভাইরাস সম্পর্কে ইসলামের বিধান: মুফতী জাকির হোসাইন আশরাফ

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২ জুলাই ২০২১  

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টি মানুষ হিসেবে বানাইছেন।পুথিবীকে সাজিয়েছেন মানুষের বসবাসের যোগ্য হিসেবে । আসমান.জমিন,গাছপালা,তরুলতা,খালবিল নদীনালা তথা পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহর ইশারায় পরিচালিত হচ্ছে। ক্ষনস্থায়ী এই পৃথিবীতে মানুষের আরাম আয়েশের মোটামুটি সকল ব্যবস্থাপনাই করেছেন। কিন্ত এর চেয়েও মহা পুরুস্কার অপেক্ষা করছে আখেরাতের ময়দানে। পৃথিবীতে স্বস্থিতে বসবাস করতে পারা যেভাবে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়।তেমনি আল্লাহ চাইলে পুরো পৃথিবীর অবস্থা পরিবর্তন করতে পারেন। মহান আল্লাহ তাআলার কতৃত্বের অসংখ্য প্রমাণ দুনিয়াতে বিদ্যমান।

তারপরেও বর্তমান কোভিড-১৯ বুুঝিয়ে দিল এতদিন পর্যন্ত হাজার কোটি মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অর্জন করা অভিজ্ঞতা আল্লাহর এক ছোট মাখলুকের কাছে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। যাইহোক সুস্থতা ও অসুস্থতার মালিক আল্লাহ তাআলা। করোনা ভাইরাস এটা আল্লাহর মাখলুক। এর সম্পর্কে যেমন অস্বীকার করাটাও ঠিক নয় তেমনি মোকাবেলা করব এমনভাবে বলাও উটিত নয়। আসুন জেনে নিই করোনা ভাইরাস তথা মহামারী সম্পর্কে ইসলাম কি বলে কিংবা এর থেকে বাঁচার উপায় কি?

 

**করোনা ভাইরাস তথা মহামারী পৃথিবীতে কেন আসে?

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্র্ণিত.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেস.হে মুহাজির দল পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপÍ হয়ে পড়লে (উপযুক্ত শাস্তি তোমাদের কে গ্রাস করবে) আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর।

যখনই কোন জাতির মাঝে অশ্লীলতা, ব্যভিচার প্রকাশ্যভাবে ব্যপক হবে, তথনই সেই জাতির মাঝে প্লেগ বা এমন রোগ বা মহামারী আসবে যা তাদের পুর্বপুরুষদের মাঝে ছিলনা।

যে জাতিই মাপ ও ওজনে কম দেবে সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, কঠিন খাদ্য-সংকট এবং শাষকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে।

যে জাতিই তার মালের জাকাত দেওয়া বন্ধ করবে.সে জাতির জন্যই আকাশ হতে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণীক’ল না থাকত, তাহলে তাদের জন্য আদৌ বৃষ্টি হত না।

যে জাতি আল্লাহ তার রাসূলের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করবে সে জাতির উপরেই তাদের বিজাতীয় শত্রæদলকে ক্ষমতাসীন করা হবে.যারা তাদের মালিকানাভুক্ত বহু ধন-সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করবে।

আর যে জাতীর শাসকগোষ্টী যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর কিতাব (বিধান) অনুযায়ী দেশ শাসন করবে,ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ অবস্থায়ী রাখবেন। ইবনে মাজাহ- ৪০১৯

তাই এই হাদীসের প্রথম অংশ দ্বারা আমরা বুঝতে পারি বর্তমান সমাজের যে অবস্থা হয়েছে ।ব্যভিচার,অশ্লীলতা যে পর্যায়ে চলছে,সুতারাং এসমস্ত ভয়াবহ রোগ কিংবা মহামারী  কেন আসবেনা? তাই বলা যায় মানুষের কৃতকর্মের কারণেই এই করোনা নামক মহামারী এসেছে।

 

**মহামারী আল্লাহর গজব

হযরত উসামা ইবনু যায়েদ রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি সাদ রাঃ কে বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহামারী সম্পর্কে আলোচনার সময় বললেন,এ একটি শাস্তি কতক জাতিকে এ দ্বারা শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তারপর এর কিছু অংশ বাকী রয়ে গেছে,তাই কখনো এ চলে যায় আবার কখনো ফিরে আসে।

বর্তমান দুনিয়াতে যে পরিমাণ নাফরমানী করা হইতেছে ,সে হিসেবে বলা যেতে পারে কোভিড-১৯ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব।

 

 **করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে করনীয়

প্রথমত  করোনা সম্পর্কে আমাদের আক্বীদা বিশ্বাসকে সহীহ করা

অর্থাৎ সুস্থতা ও অসুস্থতার মালিক মহান আল্লাহই। তাই এ ব্যপারে ধারণা স্পষ্ট করা যে করোনা এটা আল্লাহর সৃষ্ট এক মাখলুক, এর গতিবিধি আল্লাহই নিয়ন্ত্রণ করেন। করোনা ভাইরাস কাকে কখন আক্রমন করবে কিংবা এর মাধ্যমে কার মৃত্যু হবে এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত। তাই আতংকিত না হয়ে আল্লাহর উপর যেমন ভরসা রাখা উচিত তেমনই সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।

 

**ইস্তেগফার করা

শাহানশাহ মহান প্রভু আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার ক্ষমতা মানুষের নেই তাই নিজেদের গোনাহ থেকে তওবা করে আল্লাহর হুকুম পালনে নিয়োজিত থাকা

 

**স্বাস্থবিধি মেনে চলা

বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা যেহেতু করোনাকে মহামারী ঘোষনা করেছে। সাথে সাথে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের পক্ষ থেকে শরীয়ত সম্মত যে ধরনের দিকনির্দেশনা ঘোষনা হয়েছে তা মানার চেষ্টা করা।

 

**পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।তাই হাত ধুয়া,পরিষ্কার থাকা, সাবধানতা অবলম্বন করা শরীয়ত সম্মত কাজ।তাই মাস্ক ব্যবহার করা,হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা দরকার।

 

**লকডাউন

হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী ইসলামে যেমন সংক্রমক ব্যাধী নেই এটা যেমন মহা সত্য কথা, তেমনি কোন অসুস্থ রোগীর সংষ্পর্শে আসার কারণেই সে সংক্রমিত হয়েছে এমনটি মনে করা উচিত হবে না। তাই বর্তমানে সতর্কতা হিসেবে অন্য উদ্দেশ্যে নয় যদি লকডাউন ঘোষনা করা হয় এটা শরীয়ত সম্মত।

 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাঃ বলেছেন,আমি রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি তোমরা কোন অঞ্চলে প্লেগ বা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে সেখানে যাবে না।আর যদি কোন এলাকায় মহামারী ছড়িয়ে পড়ে এবং তোমরাও সেখানে অবস্থান করো,তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে এসোনা। (আবু দাউদ)

 

এই হাদীসে মহামারী এলাকায় যেতে নিষেধ করা হয়েছে কিংবা মহামারী এলাকা থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে এর দ্বারা উদ্দেশ্য এই নয় যে মহামারী এলাকায় গেলেই সংক্রমিত হবে কিংবা সংক্রমিত এলাকা থেকে কেউ এলে অন্যজন সংক্রমিত হবে। একটু খেয়াল করে বুঝতে হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের ঈমান যেন ঠিক থাকে তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে আদেশ দেন। কারন কোন ব্যক্তি সংক্রমিত এলাকায় এ জন্য যেতে নিষেধ করেছেন যেন সে যদি সংক্রমিত এলাকায় যাওয়ার পর সংক্রমিত হওয়ার পর সে ধারণা করে যে সংক্রমিত এলাকায় আসার কারণে আক্রান্ত হয়েছে। কিংবা সংক্রমিত এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গেলে যাওয়ার পর ধারণা করে সে সংক্রমিত হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। আসলে তাকদীরের ফয়সালা অনুযায়ী আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্ত থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না।

 

কঠিন জটিল রোগ থেকে বাঁচতে হাদীসে বর্ণিত দুআগুলো বেশী বেশি পাঠ করা

আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল বারাসি ওয়াল জুনুনী ওয়াল জুযামী ওয়ামিন সায়্যিইল আসকাম।

বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু মাআসমিহী শায়উন ফিসষামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওহুয়া স্সামিউল আলীম।

 

দরুদ শরীফ বেশি বেশি পড়া।

হাদীসে বর্ণিত ঔষধ হিসেবে যে খাবারগুলোর আলোচনা হয়েছে সেগুলো খাওয়া,যেমন মধু,খেজুর,কালোজিরা ইত্যাদি খাওয়া।

**মহামারী মুমীনের জন্য রহমত অবিশ্বাসীদের জন্য আযাব

হযরত আয়শা সিদ্দীকা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,আমি একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মহামারীর ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলাম।জবাবে তিনি আমাকে বললেন এটা এক রকম আযাব। আল্লাহ যার উপর চান এ আযাব পাঠান।কিন্তু মুমীনের জন্য তা তিনি রহমাত গণ্য করেছেন।তোমাদের যে কোন লোক মহামারী কবলিত এলাকায় সাওয়াবের আশায় সবরের সাথে অবস্থান করে এবং আস্থা রাখে যে আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন ত্ইা হবে,তাছাড়া আর কিছু হবে না।তার জন্য রয়েছে শহীদের সওয়াব। (বুখারী)

 

অতএব আতংকিত না হয়ে আল্লাহর ফয়সালার উপর ধর্য্য ধারণ করাই প্রকৃত মুমীনের  কাজ।

 

**অসুস্থতার মাধ্যমে মুমীনের গোনাহ মাফ হয়

হযরত আবু সাইদ খুদরী রাঃ ও হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,মুসলিম ব্যাক্তির যে কষ্ট,ক্লেশ,রোগ-ব্যাধি,উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা.দুশ্চিন্তা,কষ্ট ও পেরেশানি আসে এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে ফুটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ গুণাহসমুহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারী)

 

তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি ফয়সালা হয় করোনা আক্রান্ত হবে কিংবা এর মাধ্যমে মৃত্যু হবে তাহলে সুন্নাত হিসেবে চিকিৎসার পাশাপাশি ধর্য্যধারণ করতে হবে তাহলে মুমীনের জন্য শহীদী মরতবা হাসিল হবে।

 

**সকল রোগের ঔষধ পৃথিবীতে আছে

 নবী সাঃ একটি হাদীস হযরত উসামা ইবনু শারীক থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,মফস্বলের লোকেরা বলল,হে আল্লাহর রাসূল সাঃ আমরা কি (রোগীর) চিকিৎসা করাব না? তিনি বললেন হ্যাঁ, হে আল্লাহর বান্দাগণ তোমরা চিকিৎসা কর। আল্লাহ তাআলা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেন নি যার ঔষধ বা নিরাময়ের ব্যবস্থা রাখেন নি। কিন্তু একটি রোগের কোন নিরাময় নেই। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাঃ সে রোগটি কি? তিনি বললেন,বার্ধক্য। (তিরমিযী)

তাই করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করা এবং টিকা গ্রহণ করা।

 

**মহামারীতে মৃত্যু শহীদ

হযরত জাবির ইবনে আতীক রাঃ বর্ণিত একটি হাদীসের শেষাংসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া ছাড়াও শহীদ সাত প্রকারের ১) তাউনে বা মহামারীতে মৃত ব্যক্তি শহীদ ২) যে ডুবে মারা যায় সে শহীদ ৩) নিউমোনিয়া রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ ৪) পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ ৫) যে পুড়ে মারা যায় সে  শহীদ ৬) কোন কিছু চাপা পড়ে যে মারা গেছে সে শহীদ ৭) আত্মঃসত্ত¡ায় মৃত মহিলা শহীদ। আবু (দাউদ)

 

পরিশেষে সকলের কাছে আরজ,আসুন আতংকিত না হয়ে করোনা ভাইরাস কে ভয় নয় বরং করোনার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভয় করি।সেই সাথে আল্লাহর হুকুমগুলো নবী সাঃ এর তরীকা অনুযায়ী আমল করে নিজের জীবনকে সাজাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তৌফিক দিন।আমীন

 

মুফতী জাকির হোসাইন আশরাফ

খতিব,বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদ, বকশীগঞ্জ

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর