• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৭ এপ্রিল ২০২২  

ফারসি ভাষা থেকে আগত রোজা শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ সাওম। এর অর্থ আত্মসংযম বা বিরত থাকা। ইসলামের পাঁচটি রুকনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রুকন হলো সাওম বা রোজা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রমজানের রোজা রাখা যেমন আবশ্যক, তেমন শারীরিক সুস্থতার জন্য কার্যকরী একটি ব্যবস্থাপনা।

 

রোজা মানুষকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানবীয় গুণাবলি শিক্ষা দেয়; যেন লোভলালসা পরিহার করে কামিয়াবি হাসিল করতে পারে। যাতে তার পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। রোজা কেবল পরকালীন বিষয় নয়; এতে যথেষ্ট পার্থিব কল্যাণও নিহিত রয়েছে। ইহলৌকিক জীবনে পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভিত মজবুত হয় পবিত্র রমজান মাসে। ফলে এ মাসে শান্তির ছায়ায় ঢেকে যায় পুরো সমাজ।

 

 

ভালো স্বাস্থ্য বলতে শরীর ও মনের সুস্থতাকে বুঝায়। সুস্থতা মানুষের জন্য মহান আল্লাহ পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত। দুনিয়ার সকলেই চায় নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে। সব বয়সের মানুষের কামনা সুস্থ-সবল জীবন গড়া। তাই নিজের শরীর ঠিক রাখতে মানুষের দৌরাত্মের কমতি নেই।  শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। রোজা রাখা (উপোস থাকা) শরীরের জন্য কতটা প্রয়োজন তা আমরা  চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে জানতে পাই। মুসলিম মনীষীদের তথ্যমতেও রোজা মানব শরীরের জন্য যথেষ্ট উপকারি বলে জানা যায়। বিশ্বজগতের মহান চিকিৎসক হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (স) বলেছেন, 'প্রতিটি বস্তুর জাকাত আছে; শরীরের জাকাত রোজা।' তিনি আরো বলেন, 'রোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো পেট, অতিরিক্ত খাদ্যাভ্যাস এড়িয়ে চলা রোগের আরোগ্যতা।' তিনি বহুকাল পূর্বেই এমন কিছু নির্দেশনা প্রদান করে গেছেন, যা গবেষণা করে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ আবিষ্কার করেছেন রোগ নিরাময়ের নানা পদ্ধতি।

 

 

বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি ও গবেষণার যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, যদি সুস্থ থাকতে চাও, তাহলে রোজা রাখো। উপবাস থাকো। ড. আলেগ হিগই বলেছেন, 'রোজা রাখার ফলে মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়। প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। এটা খাদ্যে অরুচি ও অনিচ্ছা দূর করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে।'

 

ডাক্তার ক্লীভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছেন, ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এই পেপটিক আলসার রোগের প্রকোপ অনেক কম। কেননা তারা সিয়াম পালন করে থাকেন। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন- "সিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করে না।"

 

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সাহরি এবং ইফতারে পরিমিত খাবার খান, অতি ভোজন এড়িয়ে চলেন, তারা রোজা রাখার ফলে শুধু শারীরিকভাবেই উপকৃত হন না, বরং মানসিকভাবেও প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা অনুভব করতে থাকেন।

 

 

রোজা রাখার ক্ষেত্রে কয়েকটি সহজ ফর্মূলা যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে রোজার সমস্ত উপকার এবং কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব। আমরা জানি, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং শিরা-উপশিরাগুলো সচল রাখতে খাবারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এই খাবারই যদি নিয়মিত এবং পরিমিত না হয়, তাহলে শরীরে শক্তি জোগানোর পরিবর্তে রোগ সৃষ্টি করে।

 

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়- অসময়ে ও অসম ভক্ষণ হজম প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শরীরের অধিকাংশ রোগ সৃষ্টি হয় অস্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের কারণে। এই বিবেচনায় রোজা আমাদের আধ্যাত্মিক ও শারীরিকভাবে কিছু বিষয় পরিত্যাগ করার শিক্ষা দেয়।

 

 

রোজা রাখার ফলে ইউরিক অ্যাসিড এবং রক্তের ইউরিয়ার ঝুঁকিও হ্রাস পায়। যা শরীরে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি রোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের কারণ হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে ১৬-১৭ ঘণ্টা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার ফলে শরীরের অঙ্গগুলো স্বাভাবিক হতে থাকে এবং পাচনতন্ত্রের উন্নতি হয় এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ, যেমন- গ্যাস, বদহজম, লিভারের রোগ, জয়েন্টে ব্যথার ঝুঁকি ইত্যাদি কমে যায়।

 

 

সাহরি ও ইফতার রোজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা যদি এটিকে সুন্নাত অনুসারে পালন করি তবে তা কেবল শরীরের পক্ষেই ভালো নয় বরং প্রভূত কল্যাণ ও পুরস্কার লাভের কারণও হয়ে থাকে। সময়মতো সাহরি খাওয়া যেমন সুন্নত তেমন সময়মতো ইফতার করাও সুন্নত। নবীজী (সা.) এমনই করতেন। তিনি বলেন, 'তোমরা সাহরি খাও; কারণ এতে বরকত রয়েছে।'

 

 

খেজুর দিয়ে ইফতার করা নবীজীর (স) সুন্নত। আধুনিক গবেষণা অনুসারে, খেজুরে ভিটামিন এ-বি-সি-ডির পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, স্টিল, ফসফরাস এবং আরও অনেক দরকারি খনিজ রয়েছে যা কেবল হৃদ, মস্তিষ্ক, লিভার, পেট এবং স্নায়ুকেই মজবুত করে না, বরং শরীরে প্রচুর পরিমাণে শক্তিও সঞ্চার করে।

 

 

গ্রীষ্মকালে তুলনামূলক গরম থাকায় রোজা রাখলে পানির পিপাসা বেশি লাগে। এক্ষেত্রে মুসলিম গবেষকরা সাহরির সময় ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দু’চামচ খাঁটি মধু পানির সঙ্গে মিশিয়ে পান করার পরামর্শ দেন। তাতে পানির তৃষ্ণা কম হয় এবং সারা দিন প্রশান্ত থাকা যায়। মধুর মতো বরকতময় খাবার চিকিৎসা মাল্টিভিটামিনের খনিজ হওয়ার কারণে এটি রোজার সময় শারীরিক শক্তি পুনরুদ্ধার করে থাকে।

 

 

বিশেষকথা হলো, আধুনিক ডাক্তারগণ সুস্বাস্থ্যের জন্য সবসময় পরিমিত তথা কম খাওয়ার পরামর্শ দেন। রমজানে পুরো একমাস রোজা রাখার ফলে কম খাওয়ার অনুশীলন হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মেও অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ ও অপচয় করা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পানাহার করো, কিন্তু অপচয় করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ মহানবি (স) এর নির্দেশনা অনুযায়ী খাবারের নিয়ম হলো- মুমিন ব্যক্তি যখন খাবে, তখন তিন ভাগের এক ভাগ রাখবে তাঁর খাবারের জন্য, এক ভাগ রাখবে পানীয়র জন্য, এক ভাগ সে খালি রেখে দেবে, যাতে করে পেটের মধ্যে অন্তত জায়গা থাকে। অতএব পবিত্র রমজান মাসেই কম খাওয়ার অভ্যাস করার উপযুক্ত সময়।

 

 

অপরদিকে রমজান মাসে এশার নামাজের সাথে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। শারীরিক সুস্থতায় নামাজের ভূমিকাও অপরিসীম। রমজানে দীর্ঘক্ষণ তারাবির নামাজ আদায়ের ফলে মানুষের প্রয়োজনীয় শারীরিক ব্যায়াম অনুশীলন হয়ে থাকে। সঠিক পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করলে নানারকম শারীরিক সমস্যা দূর হয় বলে জানিয়েছে আমেরিকার নিউইয়র্কের বিংহ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। গবেষকরা বলেছেন, নামাজের মাধ্যমে অনেক রোগ-ব্যাধি নিরাময় সম্ভব। বিশেষ করে নার্ভের সমস্যা, জয়েন্টের সমস্যা, হাড়ে ব্যথা, মস্তিষ্ক-পেশি ও রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা ইত্যাদি উপশম হয়। রুকু-সিজদাহ ধীরেসুস্থে ঠিকঠাকভাবে করলে এ ধরনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়। 

 

 

মোটকথা কথা হলো রোজা কেবল সারাদিন উপোস থেকে নির্ধারিত সময়ে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের নাম নয়। বরং এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা শারীরিক বহুবিধ রোগব্যাধি থেকেও আমাদের রক্ষা করেন।

 

 

সর্বোপরি রোজা মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবশ্য পালনীয় একটি ইবাদত। একনিষ্ঠভাবে প্রত্যেক ইবাদত পালনে যেমনটি রয়েছে পারলৌকিক মুক্তি তেমনি আবার তাতে থাকে ইহলৌকিক মঙ্গল। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষের উপর এমন কিছু চাপিয়ে দেন না যা পালনে বান্দার জন্য কষ্টসাধ্য হয়। মানুষের জন্য কল্যাণকর বিষয়ে তিনি সম্যক জ্ঞান রাখেন। মুসলমানদের অন্তরে এ বিশ্বাস ধারণ করতে হবে যে, প্রত্যেক ইবাদতে রয়েছে দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালীন মুক্তি।

 

 

লেখক: মোঃ ফয়জুর রহমান 
সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম)
কুলকান্দী শামছুন্নাহার উচ্চ বিদ্যালয়
ইসলামপুর, জামালপুর।
দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর