• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

মৃতের দাফন সংশ্লিষ্ট বর্জনীয় কাজ সমূহ: মো. বাকী বিল্লাহ খান পলাশ

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৬ অক্টোবর ২০২২  

আমাদের প্রিয় মানুষটির মৃত্যুতে আমরা তার গোসল, জানাযা, কবর খনন, দাফন কার্য সম্পাদন করি। প্রিয় পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা একজন মুসলমানের প্রতি গভীর ভালবাসা থেকেই তার মৃত্যু পরবর্তী আমরা একাজগুলো করে থাকি।  কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, একাজগুলোর মধ্যে মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য কতইনা কল্যাণ এবং ফজিলত রেখেছেন। 

এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কোন জানাযায় শরীক হ‘ল এবং দাফন শেষে ফিরে এলো, সে ব্যক্তি দুই ‘ক্বীরাত’ সমপরিমাণ নেকী পেল। প্রতি ‘ক্বীরাত’ ওহোদ পাহাড়ের সমতুল্য। আর যে ব্যক্তি কেবলমাত্র জানাযা পড়ে ফিরে এলো, সে এক ‘ক্বীরাত’ পরিমাণ নেকী পেল’ (মুত্তাফাক্ব‘আলাইহ, মিশকাত, হাদীস নং. : ১৬৫১, ছালাত অধ্যায়-৪)। ১
গোপন বিষয়গুলো গোপন রাখল, আল্লাহ তাকে চল্লিশ বার ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতের  জন্য কবর খনন করল, অতঃপর দাফন শেষে তাকে ঢেকে দিল, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত পুরস্কার দিবেন জান্নাতের একটি বাড়ীর সমপরিমাণ, যেখানে আল্লাহ তাকে রাখবেন। যে ব্যক্তি মাইয়েতকে কাফন পরাবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের মিহি ও মোটা রেশমের পোষাক পরাবেন (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং. : ৮৮২৭, ত্বাবারানী, ছহীহ আত-তারগীব, হাদীস নং. : ৩৪৯২)।২ অথচ ছোয়াবের নিয়তে মাইয়েতের দাফন সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে আমরা এমন কিছু কাজ করি যা রাসূল (ছা.), তার সম্মানিত সাহাবায়ে কেরামগণ, তাবেয়ী বা তাবে-তাবেয়ী কারো আমল থেকেই তা প্রমানিত নয়। এমন কিছু বিষয়সমূহকে নিয়েই নি¤েœ আলোচনা করা হলো।

চল্লিশ কদম হাটা ও দশ কদম পর পার্শ্ব পরিবর্তন করা :
জানাযা কাঁধে বহন করা সুন্নাত (বুখারী, মিশকাত, হাদীস নং. : ১৬৪৬-৪৭)। আর এটি মৃতের পরিবারের সদস্য ও নিকটাতœীয়গণ প্রথম হকদার। কিন্তুু মৃতের খাটলি বহন করতে গিয়ে আমাদের মাঝে ব্যাপকভাবে যে ধারণা ও বিশ্বাসটি প্রচলিত তাহলো জানাযা কাঁধে নিয়ে চল্লিশ কদম যাওয়া এবং প্রতি দশ কদম পর পর কাঁধ ও পার্শ পরিবর্তন করা অর্থাৎ যিনি ডানে ও খাটলি ডান কাঁধে বহন করছেন তিনি দশ কদম যাবার পর খাটলির বামে এসে কাঁধ পরিবর্তন করবেন। এভাবে চল্লিশ কদম পর ব্যক্তি ও দশ কদম পর কাঁধ ও পার্শ্ব পরিবর্তন করায় রয়েছে বিশেষ ফজিলত। অথচ পবিত্র কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসের কোথাও এজাতীয় আমল এবং এর ফজিলত বর্ণিত হয়নি। শায়খ আহমাদুল্লাহ ‘সুনানে ইবনে মাজা থেকে একটি হাদীসের উদৃতি উল্লেখ করে বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি যখন কোন লাশ বহন করবে সে যেন খাটিয়ার চতুরপাশে বহন করার চেষ্টা করে। কেননা এটি সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।’ অথচ হাদীসের সূত্র ও সনদ গবেষণা করে হাদীস বিশারদগণ বিশেষকরে শেখ আহমেদ শাকের, শেখ নাসিরুদ্দিন আলবানী এ হাদীসটিকে যঈফ বলে উল্লেখ করেছেন। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে শায়খ আহমাদুল্লাহ হাদীসটিকে অগ্রহণযোগ্য এবং জানাযা আমরা স্বাভাবিকভাবে বহন করব এবং এর জন্য চল্লিশ কদম হাটা বা দশ কদম পরপর পার্শ্ব পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন নেই মর্মে উল্লেখ করেছেন।৩ আরো একটি উল্লেখযোগ্য হাদীস হলো, আনাস (রা.) বলেন, রাসূল (ছা.) বলেন, যে ব্যক্তি মৃতের চার পায়া খাটিয়ার পার্শ্ব বহন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার ৪০ টি কাবীরা গোনাহ মাফ করে দিবেন (ত্বাবারানী, আল-আওসাত্ব, তানক্বীহ, পৃষ্ঠা নং. : ৫০৫)। বস্তুুত উক্ত বর্ণনাটিকেও মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে ড. মুযাফফর বিন মুহসিন রচিত ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর ছালাত’ গ্রন্থের ৩৯৬ পৃষ্ঠায়। কেননা এর সনদে আলী বিন আবু সারাহ ও মুহাম্মাদ বিন উক্ববা সাদূসী নামে দু‘জন যঈফ রাবী আছে (সিলসিলা যঈফাহ, হাদীস নং. : ১৮৯১)।  সর্বশেষ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ খ্রি. তারিখ এনটিভির ‘আপনার জিজ্ঞাসা’র ৪৮৬তম পর্বের প্রশ্নোত্তরে জানাযা ৪০ কদম বা ১০ কদম পর কাঁধ পরিবর্তন সম্পর্কে বিশিষ্ট আলেম ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, বাস্তব প্রয়োজনে এটা করা যেতে পারে কিন্তু শরিয়তের বিধান হিসাবে এটাকে মনে করার কোন সুযোগ নেই বরং এ কাজটি বিদ‘আত।৪ 

উপস্থিত সকলের পাত্রের মাটি ছুঁেয় দেয়া :
মৃতের দাফন কার্যের সময়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের সামনে মৃতের কবরে মাটি দেয়ার জন্য উক্ত কবরের কিছু মাটি একটি পাত্রে উঠিয়ে আনা হয় এবং সমবেত সকলে উক্ত মাটি ছ্ুঁয়ে দেন। বস্তুত এ কাজটিও রাসূল (ছা.) এর কোন আমলের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত ‘কবর বন্ধ করার পরে উপস্থিত সকলে (বিসমিল্লাহ বলে) তিন অঞ্জলী মাটি কবরের মাথার দিক থেকে পায়ের দিকে ছড়িয়ে দেবে (তালখীছ, পৃষ্ঠা : ৫৮-৬৫, ৬৯, মির‘আত ‘মাইয়েতের দাফন, অনুচ্ছেদ, ৫/৪২৬-৫৭)। এভাবে মৃতের দাফনের সময় কবরের মাটি একটি ঝুড়ি বা পাত্রে করে বাড়ীর মহিলাদের সামনে নিয়ে আসা এবং তাতে দোয়া করে ঐ মাটি ছ্্্ুঁয়ে দেয়ার পর উক্ত মাটি কবরে ঢেলে দেওয়ার যে প্রথা চালু আছে তাকে একটি অমূলক রসম বলে উল্লেখ করা হয়েছে মাসিক আল-কাউসার এর বর্ষ ১২ এর ১ম সংখ্যায়।৫

কবরের উপর খেজুরের ডাল পুতে দেয়া :
আমরা আমাদের প্রিয় মানুষটিকে কবর দিয়ে তার কল্যাণার্থে আরো একটি কাজ করে থাকি তা হলো কবরের উপর খেজুরের কাঁচা ডাল পুতে দেয়া। এ কাজটি আমরা করে থাকি এই ভেবে যে যতদিননা ডালটি শুকিয়ে যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ব্যক্তির কবরের আযাব লাঘব হবে। বস্তুুত রাসূল (ছা.) এর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা এ কাজটি করে থাকি তা হলো, ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, একদা রাসূল (ছা.) দু‘টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কবর দু‘টি দেখে বললেন, দু‘টি কবরেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে বড় কোন কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। অতঃপর বললেন, তাদের একজন নিজেকে পেশাব হতে বাঁচাত না অপরজন পরনিন্দা করতো। অতঃপর রাসূল (ছা.) খেজুর গাছের কাঁচা ডাল আনতে বললেন। এবং তা দ্বিখন্ডিত করলেন এবং বললেন, সম্ভবত ডাল দু‘টো না শুকানো পর্যন্ত কবরবাসীর শাস্তি লাঘব হবে (বুখারী, হাদীস নং. : ১৩৭৮, মুসলিম, হাদীস নং.: ২১৬, ২৯২)। রাসূল (ছা.) এর উপর্যুক্ত ঘটনা থেকে আমরা কবরে কাঁচা ডাল পুতে দেয়ার কাজটি করলেও প্রকৃত অর্থেই আমরা এটিকে সুন্নাত হিসাবে আমল করব কিনা তা রাসূল (ছা.) এবং তার ছাহাবীদের আমল থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। তাহলো প্রথমত এটি ছিল রাসূল (ছা.) এর একান্তই বিশেষ একটি ঘটনা। দ্বিতীয়ত তিনি যে দু‘টি কবরে কাঁচা ডাল পুতে ছিলেন তা নতুন বা টাটকা কোন কবর ছিল না বা উক্ত কবর দু‘টিকে তিনি দাফনও করেননি। আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ মুসলিম শরীফের উদৃতি দিয়ে বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছা.) গায়েবের খবর জানেন না। হযরত জিব্রাইল (আ.) তাকে উক্ত দু‘টি কবরের আযাব সম্পর্কে জ্ঞাত করেন এবং রাসূল (ছা.) কে উক্ত কাজটি সম্পাদন করতে বলেন। রাসূল (ছা.) এ কাজটি থেকে এ শিক্ষাও প্রদান করেন যে, মানুষ যেন পেশাবের নাপাকি থেকে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখে এবং পরনিন্দা থেকে বিরত থাকে।৬ তৃতীয়ত রাসূল (ছা.) এর সময়ে অনেক ছাহাবী ইন্তেকাল করেছেন। অনেক ছাহাবীকে তিনি কবরস্থ করেছেন কিন্তু কোন ছাহাবীর কবরেই তিনি কাঁচা ডাল পুতে দেননি। চতুর্থত পরবর্তীতে যে সকল ছাহাবী মারা গেছেন অন্য ছাহাবীগণ কখনোই তাদের কবরে এরুপ করেননি। যদি এ কাজটি অনুসরণীয়ই হতো তবে রাসূল (ছা.) তার সঙ্গী-সাথীদের এ কাজটি করতে নির্দেশ দিতেন বা উৎসাহ প্রদান করতেন। কিন্তুু তিনি কখনোই তা করেননি। ব¯ু‘ত রাসূল (ছা.) ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে, উক্ত দু‘টি কবরে আযাব হচ্ছে ফলে দয়া পরবশ হয়ে তিনি নিজ হাতে বরকতের আশায় এ কাজটি করেছিলেন। কিন্তু আমরা কি জানি কোন কবরে শাস্তি হচ্ছে? সুতরাং সুস্পষ্টভাবেই কবরের উপর খেজুরের ডাল পুতে দেয়া স্পষ্টত বিদআ‘ত বলে উল্লেখ করেছেন উম্মে মারিয়াম রাযিয়া বিনতে আযীযুর রহমান তার লিখিত ‘মুমূর্ষু থেকে কবর পর্যন্ত’ গ্রন্থের ৫৭ পৃষ্ঠায়।

পরিশেষে মহান আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা প্রাপ্তি ঘটে আমাদের প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর পর আমরা যেন তার প্রতি সে কাজটুকু করতে পারি মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমীন।  


সহায়ক গ্রন্থ ও উৎস সমূহ :
১.    ছালাতুর রাসূল (ছা.) - মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা : ২১৩
২.    জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর ছালাত -  ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, পৃষ্ঠা নং. : ৩৯৬
৩.    লাশের খাটিয়া বহন করে ৪০ কদম যাওয়ার বিধান - শায়খ আহমাদুল্লাহ 
৪    লাশের খাট বহনের ১০ কদম পর পর কি কাঁধ পাল্টাতে হয় - এনটিভি, আপনার জিজ্ঞাসা, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ খ্রি. ৪৮৬ পর্ব
৫      একটি ভূল রসম : ঝুড়িতে করে কবরের মাটি এনে বাড়ির মহিলাদের থেকে ছুঁয়ে নেওয়া - মাসিক আল-কাউসার, বর্ষ ১২, সংখ্যা ১
৬    নতুন কবরে খেজুর ডাল পুঁেত দেওয়ার রহস্য কি? -  শাইখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর