• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

হ্যানসি ক্রনিয়ে: নায়ক থেকে ভিলেন, তবুও ভালোবাসায় অমর

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১ জুন ২০২৩  

১১ এপ্রিল, ২০০০ সাল। ঘড়িতে তখন রাত ৩টার কাটা ছুঁই ছুঁই। আর কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুটবে দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশে। দেশটির প্রায় সবাই শেষ রাতের মধুর ঘুম উপভোগে ব্যস্ত। তবে প্রোটিয়া ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হ্যানসি ক্রনিয়ে অস্থির হয়ে বাসায় পায়চারি করছেন। শেষমেশ আর পারলেন না তিনি। ধৈর্য্যের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে রাতের সেই সময়েই ফোন করলেন আলি ওয়েচারকে।
বিগত কয়েকদিন ধরেই ধকল যাচ্ছে ইউনাইটেড ক্রিকেট বোর্ড অফ সাউথ আফ্রিকার (তৎকালীন ইউসিবিসিএ, বর্তমানে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা) প্রধান আলির ওপর। বিশেষ করে চারদিন আগে ভারত থেকে দাবি করা হয়েছে, হ্যানসি নাকি ম্যাচ গড়াপেটার সঙ্গে যুক্ত! অন্যদের মতো তিনিও ঘটনাটি বিশ্বাস করেননি। হ্যানসি নিজেও দিন দুয়েক আগে দাবি করেছেন তিনি নির্দোষ। এমন সময় শেষ রাতের একটু আগে অধিনায়কের ফোন দেখে চমকে উঠলেন ইউসিবিসিএ প্রধান।

আলি যখন ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শুনলেন- ‘আমি একেবারেই বিশ্বস্ত নই’, তখন তার কি অবস্থা হয়েছিল জানা নেই। তবে হ্যানসি ক্রনিয়ের এই স্বীকারোক্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। বলা যায় ক্রিকেট দুনিয়ায় যে ম্যাচ গড়াপেটাও হতে পারে, সে বিষয়টি এই ঘটনার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারে সবাই। দিন কয়েকের মাঝে কিং কমিশনের সামনে কাঁদতে কাঁদতে নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেন হ্যানসি। যার শাস্তি হিসেবে ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হলেন দেশটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। নায়ক থেকে হয়ে গেলেন প্রোটিয়া ক্রিকেটের কালো অধ্যায়ের ‘ভিলেন।’

অথচ হ্যানসি ক্রনিয়ের শুরুটা দেখে এমন সমাপ্তির কথা ভাবতেও পারেনি কেউ। ১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইনে এভি ক্রনিয়ে এবং সান-মেরি ক্রনিয়ের ঘর আলো করে তার জন্ম। পরিবারের মেজো ছেলেটির পুরো নাম ছিল ওয়েসেল জোহানেস হ্যানসি ক্রনিয়ে। ছোট থেকেই ছিলেন দারুণ মেধাবী। ১৯৮৭ সালে ব্লুমফন্টেইনের গ্রে কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি, ছিলেন হেড বয়। তার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয়েছিল সেই সময়েই।

হ্যানসি ক্রনিয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আন্দ্রে ভোলসটেড তার ছাত্রকে নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন। একদিন ক্রনিয়ে নিজেই তাকে বলেছিলেন, ক্রিকেটের মক্কাখ্যাত লর্ডসে খেলার সুযোগ পেলে স্যারকে বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দেবে। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখা সেই বালক হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন, তার দেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তখনও নিষিদ্ধ! অবশ্য পরে ঠিকই ক্রিকেটে ফেরে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯৪ সালে লর্ডসে যখন খেলতে নেমেছিলেন, ঠিকই শিক্ষকের কাছে টিকিট পাঠিয়েছিলেন নায়ক থেকে ভিলেনে পরিণত হওয়া এ ক্রিকেটার।

অরেঞ্জ ফ্রি স্টেইটের হয়ে ১৯৮৮ সালে ট্রান্সভালের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মাত্র ১৮ বছর বয়সে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। তিনি এতটাই প্রতিভাবান ছিলেন যে একই সময়ে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট প্রদেশের ক্রিকেট এবং স্কুল পর্যায়ে রাগবিতে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শুধু খেলেননি, স্কুলের ক্রিকেট এবং রাগবি দলের অধিনায়কত্বও করেছেন ক্রনিয়ে। বলা যায় নেতৃত্ব দেওয়া ছিল তার সহজাত গুণগুলোর একটি।

ফ্রি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা ক্রনিয়ে জাতীয় দলে ডাক পান ১৯৯২ বিশ্বকাপের কিছুটা আগে। দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে সে বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরে দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বকাপের আগে ভারত সফরে স্কোয়াডে থাকলেও মাঠে নামার সুযোগ পাননি। ক্রনিয়ের প্রোটিয়া জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে। ১৯৯২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। সে ম্যাচেই ১৫তম প্রোটিয়া ক্রিকেটার হিসেবে ক্রনিয়ের অভিষেক হয়।

বিশ্বকাপটি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য অন্তহীন আফসোসের অপর নাম। এখানে হাস্যকর বৃষ্টি আইনের শিকার হয়ে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় প্রোটিয়ারা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে জয়ের জন্য একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান। এমন সময় নামে বেরসিক বৃষ্টি। পরে যখন আবার ব্যাট করার সুযোগ আসে, তখন প্রোটিয়াদের লক্ষ্য দাঁড়ায় এক বলে ২১ রান! এমন দুর্ভাগ্যের আসরে ৮ ম্যাচে ৩৪ গড়ে ২৭২ রান করেন ক্রনিয়ে। সেই শুরুর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

দুই বছরের মাথায় দলের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে সহকারী অধিনায়ক নির্বাচিত হন ক্রনিয়ে। কেপলার ওয়েসেলসের ইনজুরিতে বেশ কিছু ম্যাচে স্ট্যান্ড-ইন ক্যাপ্টেন হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে সবার প্রশংসা কুড়ান তিনি। দারুণ পারফরম্যান্সের পাশাপাশি নেতৃত্বগুণের ফলে ১৯৯৪ সালের শেষদিকে নিউজিল্যান্ড সফরে পুরোপুরিভাবে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান এ অলরাউন্ডার। ২০০৮ সালে এক প্রামাণ্যচিত্রে ভোলসটেড বলেন, ‘ক্রনিয়ে যে অধিনায়কত্বের জন্য যোগ্য একজন ছিলেন সেটা নিয়ে কেউ কখনো দ্বিমত পোষণ করেননি।’

অধিনায়ক হিসেবে ক্রনিয়ে ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তার বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড বলেন, ‘হ্যানসি বলতেন আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল হিসেবে তৈরি করবো। একইসঙ্গে সেরা ওয়ানডে দল হিসেবে খেলবো ও পৃথিবীর সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটিং জাতি হিসেবে তৈরি হব। স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিক দিয়ে ম্যান্ডেলা ও হ্যানসি ছিলেন সমান্তরাল।’

ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় স্বপ্ন পূরণের পথে দৃঢ়ভাবেই এগিয়ে গেছেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। অন্তত অধিনায়ক হিসেবে তার পরিসংখ্যান সে কথাই বলে। ক্রনিয়ের অধীনে ১৮টি টেস্ট সিরিজ খেলে দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে তারা জয় পায় ১৩টি সিরিজে! ৪টি সিরিজে পরাজয়ের পাশাপাশি একটি সিরিজ ড্র, সে সময়ের ভঙ্গুর দক্ষিণ আফ্রিকার এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্রনিয়ে। এছাড়া ওয়ানডেতে ১৩৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৯৯টি ম্যাচে দলকে জয় এনে দিয়েছেন তিনি, হারের মুখ দেখেছেন ৩৫ ম্যাচে।

১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা একটি ভাষণে বলেন, ‘খেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে, দেশকে এক করা। আমি হ্যানসি ক্রনিয়েকে আলাদাভাবে অভিনন্দন জানাব। তিনি যেভাবে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২০০০ সালের এপ্রিলে ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু। সে মাসের ৭ তারিখে অভিযোগ আনা হয়, চার বছর আগে (১৯৯৬ সাল) তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের মাধ্যমে ভারতীয় জুয়াড়ি মুকেশ গুপ্তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ম্যাচ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্রনিয়ে। অবশ্য কিং কমিশনের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে ক্রনিয়ে জানান, তিনি টাকা নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু পাতানো ম্যাচ খেলেনি তার দল। আজহারউদ্দিনের জীবনী নিয়ে বলিউডে তৈরি হওয়া ছবি আজহারেও এ বিষয়টি উঠে আসে।

ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ সামনের আসার মাস তিনেক আগে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক উদাহরণ তৈরি করেন ক্রনিয়ে। সেবার সেঞ্চুরিয়নে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের শেষ টেস্টে অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বৃষ্টিতে ম্যাচটির তিনদিন ভেসে যায়। শেষদিনে দুই দলের লড়াই নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছিল। এমন সময় ফাটকা খেলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেইনকে এক ইনিংস ব্যাট না করে সোজা ২৪৯ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেন তিনি। সেদিন উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচটি পাঁচ বল বাকি থাকতে জিতে যায় ইংল্যান্ড।

অমীমাংসিত হতে যাওয়া একটি টেস্টে প্রাণ ফিরিয়ে আনায় হ্যানসি ক্রনিয়ের এমন সাহসী সিদ্ধান্ত সে সময় সবার ভূয়সী প্রশংসা আদায় করে নেয়। কিন্তু পরে জানা যায় অন্য কিছু! মার্লন অ্যারনস্ট্যাম নামের একজন জুয়াড়ি সেই ম্যাচের মধ্যে ক্রনিয়েকে ফোন দিয়ে তাকে দেখা করতে বলেন। এরপর সেই জুয়াড়ির প্রস্তাবে রাজি হন ক্রনিয়ে, যার ফল ছিল সেই ‘প্রশংসিত’ সিদ্ধান্ত! জানা যায়, সে ম্যাচে আড়াই হাজার ডলার জিতেছিলেন মার্লন অ্যারনস্ট্যাম। সেদিন অ্যারনস্ট্যাম জিতলেও বিক্রি হয়েছিল টেস্ট ক্রিকেট, হেরেছিল লাল বলের গৌরব।

মূলত সহজে টাকা কামাতে চাইতেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। তার বড় ভাই ফ্রান্স ক্রনিয়ে নেটফ্লিক্সের সিরিজ ব্যাড স্পোর্টের ‘ফলেন আইডল’ পর্বে বলেন, ‘অর্থ আয় করা একটা নেশা ছিল হ্যানসির। যত সহজে আয় করা যায় ততই উপভোগ করতেন তিনি।’

কথায় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ক্রনিয়ের ক্ষেত্রেও হয়েছিল সেটাই। ২০০০ সালের মার্চে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সে ম্যাচেও জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে যাচ্ছিলেন ক্রনিয়ে। এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ চলার সময় দিল্লি পুলিশ একটি কল রেকর্ড প্রকাশ করে। যেখানে হ্যানসি ক্রনিয়ের সঙ্গে ভারতের জুয়াড়ি সিন্ডিকেটের এক প্রতিনিধি সঞ্জীব চাওলার কথোপকথন শোনা যায় বলে অভিযোগ তোলা হয়।

কথোপকথনে শোনা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার অফ স্পিনার ডেরেক ক্রুকস ভারতের বিপক্ষে চলমান সেই সিরিজের কোনো একটি ম্যাচে শুরুতেই বল করবেন। এছাড়া দলের তারকা ব্যাটার হার্শেল গিবস ২০ রানের বেশি করবেন না। এ বিষয়ে ডিল ফাইনাল করেন ফোনের লাইনে থাকা দু’ব্যক্তি।

ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝে অনুষ্ঠিত সেই সিরিজের তৃতীয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ফরিদাবাদে। যে ম্যাচে হার্শেল গিবস ১৯ রানে আউট হন। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচে নাগপুরে বল হাতে ইনিংস উদ্বোধন করেছিলেন ডেরেক ক্রুকস। ম্যাচটিতে ছয় ওভারে ৫৩ রান দেন ক্রুকস। প্রমাণগুলো মিলে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে ক্রনিয়ে সকল দায় অস্বীকার করেন। 

তবে দিন চারেকের মাথায় সব স্বীকার করে নেন হ্যানসি ক্রনিয়ে। যার মাধ্যমে পতন হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উজ্জলতম এক নক্ষত্রের। মাত্র ৮ বছরের ক্যারিয়ারে ক্রনিয়ে অর্জন করেছিলেন অনেক কিছু। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৮টি টেস্ট ম্যাচে ৩৬.৪১ ব্যাটিং গড়ে ৩,৭১৪ রানের পাশাপাশি তিনি ৪৩টি উইকেট শিকার করেন। এছাড়া ১৮৮টি ওয়ানডে ম্যাচে ৩৮.৬৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,৫৬৫ রান করার পাশাপাশি ১১৪বার উইকেট শিকারের আনন্দে মাতেন এ অলরাউন্ডার।

অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড ক্রনিয়ের দখলে। তিনি ১৩৮টি ওয়ানডে ম্যাচে প্রোটিয়াদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (সর্বোচ্চ গ্রায়েম স্মিথ, ১৪৯ ওয়ানডে)। অধিনায়ক হিসেবে ৯৯টি জয়ের মাধ্যমে রিকি পন্টিং, অ্যালান বর্ডার এবং মহেন্দ্র সিং ধোনির পরে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া জয়ের শতাংশের দিক থেকে (৭৩.৭০) বিশ্বের চতুর্থ সফল অধিনায়ক এ অলরাউন্ডার।

১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০০ সালের মার্চ অর্থাৎ জীবনের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত টানা ১৬২টি ওয়ানডে খেলেছেন ক্রনিয়ে। যা একটি দক্ষিণ আফ্রিকান রেকর্ড। এছাড়া অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি টানা ওয়ানডে (১৩০) ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তার দখলে। এক্ষেত্রে তার মহত্ব কতটা? অধিনায়ক হিসেবে টানা ১০০-র বেশি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা একমাত্র খেলোয়াড় যে ক্রনিয়ে!


ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হওয়ার পর বাইশ গজ থেকে পুরোপুরি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন ক্রনিয়ে। ক্রিকেট জগতের প্রায় সকলেই তাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি, ক্রিকেটের মহানতম এ অধিনায়ক এমন নোংরা কাজও করতে পারেন। ক্রিকেট ছেড়ে জোহানেসবার্গের ‘বেল ইকুইপমেন্ট’ কোম্পানির হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন ক্রনিয়ে। কিন্তু সেখানেও তার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

চাকরির একবছর তখনও পূর্ণ হয়নি। অন্যান্য সময়ের মতো স্ত্রীর সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে ২০০২ সালের ১ জুন তিনি ছোটো একটা কার্গো প্লেনের একমাত্র যাত্রী হিসাবে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এটাই যে তার শেষ যাত্রা ছিল কে জানতো? জোহানেসবার্গ থেকে নিজের শহর জর্জে ফিরছিলেন ক্রনিয়ে। কিন্তু কেপটাউন থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। যেখানে তিনিসহ মারা যান দুজন পাইলটও। সে সময় ক্রনিয়ের বয়স ছিল ৩২ বছর ২৪৯ দিন।

ক্রনিয়ের মৃত্যু নিয়ে নানা সময়ে উঠে এসেছে নানা মত। কেউ বলেন জুয়াড়িদের অনেক তথ্য ফাঁস করার শাস্তি হিসেবে এভাবেই তাকে হত্যা করা হয়। কেউ আবার এটাকে নিছকই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেন। তবে ক্রনিয়ের মৃত্যুর বছর পাঁচেক পর ২০০৭ বিশ্বকাপের মাঝে তার এক সময়ের গুরু ও তৎকালীন পাকিস্তান দলের হেড কোচ বব উলমার রহস্যজনকভাবে হোটেলরুমে মারা যান। তার মৃত্যুর পর ফের দানা বাঁধে সন্দেহ। যেখানে ধারণা করা হয়, ম্যাচ পাতানোর চক্র তাদের তথ্য-প্রমাণ মুছে ফেলার জন্যই হয়তো ক্রনিয়ের পর উলমারকেও মেরে ফেলে।

ক্রনিয়ে জুয়াড়িদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ম্যাচ গড়াপেটা করেছেন। যে কারণে একই পাপ করা অন্য অনেকের মতো তারও ঘৃণিত হওয়ার কথা ছিল। ম্যাচ পাতানো কোনো ক্রিকেটারকে কে পছন্দ করবে? কিন্তু অবাক হলেও সত্য, ক্রনিয়ে ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে জড়ালেও ঘৃণিত নন। তাকে কেউ অশ্রদ্ধা করেন? এটাও খুব বেশি ক্রিকেট সমর্থক বলতে পারবে না। নিজের দোষ স্বীকার করার পরও ক্রনিয়ের জন্য একটা দুর্বল জায়গা আছে ক্রিকেট সমর্থকদের মনে।


আর দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মনে এখনো তিনি শ্রদ্ধার একজন তো বটেই। নইলে কি আর ‘সর্বকালের সেরা ১০০ দক্ষিণ আফ্রিকান’-এর তালিকায় ১১তম হিসেবে ক্রিকেট মাঠের এই ‘ভিলেন’কে বেছে নেয় তারা? তাও আবার তার রহস্যজনক মৃত্যুর দুই বছর পর!

শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাতেই? ফিক্সিং কেলেংকারির পরও বিশ্বজুড়ে সবার কাছে ভালোবাসার এক নাম হ্যানসি ক্রনিয়ে। যে নামের সঙ্গে মিশে আছে হতাশা আর আক্ষেপও…

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর