• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

স্পেনের ক্লাবে প্রথম বাংলাদেশি তরুণ ফুটবলার

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০২০  

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসিসহ দুনিয়া কাঁপানো অসংখ্য ফুটবলার ১৩-১৪ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছেন ফুটবলের জন্য। সেই তুলনায় তাহসিনের বয়সটাও খুব বেশি নয়। সদ্য পেরিয়েছেন কৈশোর। তাও ১৫ দিন আগে। আর এই বয়সেই বাড়ি ছেড়েছেন তাহসিন। পাড়ি জমিয়েছেন ইউরাপে। তাও সেই দেশে আগে কখনও যাননি। মাকে ছেড়ে আগে কখনও একা থাকা হয়নি তার। সেই তাহসিন পরিবার ছেড়ে একাই পাড়ি দিলেন ইউরোপ। ভাত ছেড়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন পাস্তায়। এখানে আসার পর কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তাহসিন বলেন, 'খুবই একাকিত্বে ভুগেছি প্রথম কয়েকদিন। এখন আস্তে আস্তে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে ফুটবলের জন্য যে কোনো কষ্ট আমি মেনে নিতে পারি। এটা খুব ভালো জানেন আমার মা। মাকে খুব মিস করি।'

মালাগা, ফুটবলার গড়ার কারখানা

২০১৩ সালে যাত্রা শুরু মালাগা সিটি এফসির। অনূর্ধ্ব-১৯ দিয়ে শুরু তাদের কার্যক্রম। অনূর্ধ্ব-২৩ হয়ে আলমুনেকার। এটি তাদের মূল দল। ক্লাবটি মূলত ফুটবলার গড়ে আর ত্রেসেরা ডিভিশনে বিক্রি করে। ত্রেসেরা স্পেনের তৃতীয় স্তরের ফুটবল। এর ওপর সেগুন্দা ডিভিশন, তার ওপর প্রিমেরা ডিভিশন। যাকে আমরা বলি, লা লিগা। ত্রেসের ডিভিশন স্কেয়াডে পর্যাপ্ত অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলার না থাকলে স্প্যানিশ ফুটবলের লাইসেন্স মেলে না। মূলত এসব দলে খেলোয়াড় জোগান দেয় মালাগা সিটি এফসি। তাহসিন যোগ দিয়েছেন সেই অনূর্ধ্ব-২৩ দলে। যদিও তার বয়স ১৯।

করোনা এনে দিল সুযোগ

ফুটবল নিয়ে তাহসিনের পাগলামি সেই এইটুকুন বয়স থেকে। তার মা ফারহিম ভীনা বলেন, 'ফুটবলের কথা শুনলে আর হুঁশ থাকে না তার। এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে সেই পাগলামি। এই তো, গত বছর আমেরিকা ভ্রমণের প্রায় সব ঠিকঠাক হলো। হুট করে বলে, আমার পক্ষে আমেরিকা যাওয়া এখন সম্ভব নয়। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। সে এবং তার ভাই প্রিতুর বায়নায় আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। অথচ দুজনই বেঁকে বসলো। পরে জানলাম, স্কুলে তাদের ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেই খেলার চেয়ে তাদের কাছে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ক্যালিফোর্নিয়া বড় হতে পারে না।' এই পাগলামি মাথায় নিয়ে লকডাউনে ঘরে বসে নিজের খেলার কিছু ফুটেজ দিয়ে একটা ভিডিও বানান তাহসিন। অনলাইনে খুঁজে পান মালাগা সিটি এফসির নাম। সিভি আর সেই ভিডিও ফুটেজ দিয়ে আবেদন করেন তাহসিন। তার ভিডিও দেখেই মালাগা সিটি এফসি চুক্তিপত্র পাঠিয়ে দেয়। ক্লাবের অপারেশন্স ম্যানেজার ইভান অর্তিজ। তিনি চুক্তিপত্রের সঙ্গে লিখলেন, সাত দিনের মধ্যে স্পেনে চলে আস। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল। করোনায় ওলট-পালট বিশ্ব। তবু চেষ্টা চালিয়ে যান তাহসিন। অবশেষে ১৫ অক্টোবর উড়াল দেন স্পেনের উদ্দেশে।

ক্লাব ব্যস্ততা

ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে ব্যস্ততা। তবে সব ব্যস্ততা ফুটবলকে ঘিরেই। তাহসিনের অনূর্ধ্ব-২৩ দল ইউয়েফার 'প্রো' আর 'এ' লাইসেন্সধারী কোচদের অধীনে সাতদিনের ছয়দিন অনুশীলন করে। এ ছাড়া রুটিন করে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলের বিপক্ষে খেলছে ম্যাচ। নিয়মমাফিক খাওয়ার পাশাপাশি থাকতে হচ্ছে ফিজিওদের চেকআপে। শিখছেন স্প্যানিশ। স্পেনের বাইরের খেলোয়াড়দের জন্য এই ভাষাশিক্ষা কোর্স বাধ্যতামূলক।

চলবে একাডেমিক পড়াশোনাও

মা-বাবা আর ছোট ভাইসহ তাহসিন থাকতেন উত্তরায়। চার নম্বর সেক্টরে। বাসার সামনে বড় মাঠ। সে মাঠেই দিন কাটত তাহসিনের। প্রথম শ্রেণি থেকেই ফুটবল খেলতেন তাহসিন। স্কলাস্টিকা ছিল তার স্কুল। এখনও পড়ছেন স্কলাস্টিকায়। নিয়মিত স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতেন। আর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা প্রতিবার তার জন্যই তোলা থাকত। বাসার একটা রুম সাজানো তার অ্যাওয়ার্ড দিয়ে। একটু বড় হয়ে খেলেন আন্ডারগ্রাউন্ড ফুটবল। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করেন। স্কলাস্টিকার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তাহসিন। দেশ ছাড়ার আগে রাজি করিয়েছেন স্কুলকেও। স্পেনে থাকা দশ মাস ক্লাস করবেন অনলাইনে। দশ মাস পর দেশে ফিরে বসবেন পরীক্ষায়।

বাম পায়ের ফুটবলার

সদ্য কৈশোর পেরিয়েছেন তাহসিন। তবে তার ফুটবল-জ্ঞান মুগ্ধ করে যে কাউকে। মেসিতে বুঁদ তাহসিন খেলেনও মেসির পজিশনে। যাকে বলে 'ফলস নাইন'। ফুটবলে এই পজিশনের আবিস্কারও মেসিকে দিয়েই। তাহসিনের ফুটবল পজিশন নিয়ে তার স্কুল স্কলাস্টিকার ফুটবল কোচ এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ফয়সাল আহমেদ বলেন, 'তাহসিন রাইট উইং অথবা সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ড- এই দুই পজিশনে খেলে। তবে তার মতে, তাহসিনের আসল পজিশন ফলস নাইন।' এই নিয়ে তাহসিনেরও গর্বের শেষ নেই। তাহসিন বলেন, 'আমি মেসিতে অজ্ঞান। তার খেলা মিস করেছি এমনটা বিরল। আমার আশার আলো মেসি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আমিও মেসির মতো বাম পায়ে ফুটবল খেলি।'

আগামীর স্বপ্ন

ফুটবল দিয়েই দুনিয়া জয় করতে চান তাহসিন। তবে তার হতাশাও রয়েছে কিছুটা। দেশে অনেক চেষ্টা করেছেন। ভালো একটা ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হতে। বসুন্ধরা কিংসের অনূর্ধ্ব-১৭ দলে ট্রায়ালও দিয়েছিলেন। 'ইয়েস কার্ড' পেয়েছিলেন। তবে বসুন্ধরা যতদিনে বয়সভিত্তিক দলের অনুশীলন শুরু করে ততোদিনে ১৭ বছর বয়সী তাহসিন পা দেন ১৮-তে। ক্লাব তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ১৮ হয়ে গেছে বয়স। তাহসিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তবু ভেঙে পড়েননি তাহসিন। লেগে থাকেন ফুটবলে। পেয়ে যান সফলতা। যদিও তার ভাষায়, 'ফুটবল নিয়ে আমার যাত্রা মাত্র শুরু! তবে এই কয়দিনে দেশের মানুষের আগ্রহ এবং যেই ভালোবাস পেয়েছি তা পুঁজি করে অনেক দূর যেতে চাই। কেননা আমার অর্জন নিজের ওপর আস্থা, প্রিয় দেশ আর মানুষের ভালোবাসা।' মেসিতে বুঁদ তাহসিন একদিন নিজের স্টাইল তৈরি করে নেবেন ফুটবলে। হাজারো তরুণকে দেখাবেন ফুটবল কারিকুরিতে দুনিয়া জয়ের প্রত্যাশা। তাকে ঘিরে আমাদের এমন স্বপ্নের চারাগাছও বটবৃক্ষ হয়ে উঠবে; সেই দিনের প্রতীক্ষায় থাকতেই পারি।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর