• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

মসলিন কাপড়ে ফিরে আসবে বাংলার ঐতিহ্য

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৮ ডিসেম্বর ২০২২  

মসলিন বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সূতা দিয়ে তৈরি করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়, এটি ঢাকাই মসলিন নামেও পরিচিত। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হতো।
চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হতো, যার ফলে মসলিন হতো কাচের মতো স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হতো। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হত যার মধ্যে জামদানি এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধের দিকে বাংলায় মসলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

মসলিন প্রস্তুত করা হত পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চলে। কথিত আছে যে, মসলিনে তৈরি করা পোশাক সমূহ এতই সূক্ষ্ম ছিল যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, ১৮৫৬ সালের পর আমাদের দেশে আর ঢাকাই মসলিন কাপড় তৈরি হয়নি। এ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কারো ছিল না কোনো নজর। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে ফিরিয়ে আনতে নজর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পরিকল্পনায় ২০১৪ সালে মসলিন ফিরিয়ে আনতে নির্দেশনা মোতাবেক কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে চালু করেছিলেন সোনালী মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্প। সরকারের প্রচেষ্টা ও দেশের মসলিন গবেষকদের কঠোর পরিশ্রমে মসলিন কাপড় উৎপাদনে সক্ষম হন তারা।

এখন গবেষকদের চেষ্টায় চলছে মসলিন কাপড় তৈরির মূল উপকরণ ফুটি কার্পাস তুলা চাষ সম্প্রসারণ নিয়ে গবেষণা। এরমধ্যেই তৈরি হয়েছে সম্ভাবনা। গবেষকদের আশা, এভাবেই ধাপে ধাপে আমাদের দেশ মসলিন কাপড় উৎপাদনে পথে এগিয়ে যাবে।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় যেভাবে মেলে ফুটি কার্পাসের খোঁজ:

এ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন। সম্প্রতি কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল তার দলটির প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোনো চিহ্নও। ছিল শুধু সুইডস গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা স্পেসিস প্লান্টেরাম, আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিনের মতো কিছু বই। এরমধ্যে ক্যারোলাস লিনিয়াসের বইতে মসলিন কাপড় বোনার জন্য ফুটি কার্পাস উপযুক্ত বলে উল্লেখ ছিল। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়।

গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি টেলিভিশনেও প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এরমধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দেন।

এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল কলেজে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মাইকিং করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক, বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কান্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান।

এছাড়াও দীর্ঘদিন পরিশ্রমের পর বিদেশের জাদুঘরে থাকা মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করেন। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার ফুটি কার্পাস গাছের মিল পান অবশেষে। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাদের কাঙ্খিত জাতের ফুটি কার্পাস। স্থানীয় মাদরাসা শিক্ষক আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাকে একটি মোবাইল উপহার দেওয়া হয়।

এদিকে গাজীপুরের-৪ আসনের এমপি সিমিন হোসেন রিমি উদ্যোগ নেন কাপাসিয়ার সেই হারানো কার্পাস চাষ সম্প্রসারণের। তিনি যোগাযোগ করেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে। কৃষকরা এগিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর মসলিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ কাপড় উৎপাদনের মূল উপকরণ কার্পাস তুলার যোগানের পথ খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা এখন দেখা দিয়েছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর