• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

তাদের রক্তের সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না: বঙ্গবন্ধু

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১০ জুন ২০২০  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রোডম্যাপ ছয় দফা আন্দোলন। এই ছয় দফার প্ছরভাব্য়র ভীত হয়েই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়েছিলো তাঁকে। '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিলো এই ছয় দফার কারনেই। ছয় দফা আন্দোলন শেখ মুজিবকে করেছে 'বঙ্গবন্ধু'। এই কর্মসূচিকে ঘিরে গবেষণা করেছেন অনেকেই। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল তখন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছয় দফা কর্মসূচির প্রণেতা এবং আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের রুপকার, তাঁর কাছে ছয় দফা কি ছিল? কেন তিনি দলের ভেতরে-বাইরে এত সমালোচনা স্বত্ত্বেও ছয় দফাকে আঁকড়ে ছিলেন? নিচের লেখাগুলো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী মুলক গ্রন্থ 'কারাগারের রোজনামচা' থেকে উদ্ধৃত। বইটির বিভিন্ন স্থানে ছয় দফা সম্পর্কিত লেখা পাওয়া যায়। সেগুলোই সংকলন করে এখানে তুলে ধরা হয়েছেঃ

 

হাইকোর্ট থেকে একটা হুকুম পেয়েছি যে বক্তৃতার মামলায় জনাব মালেক- প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকার হাইকোর্টে আপীল করেছেন। আগামী ২৯ তারিখে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি হবে বলে নোটিশ পেয়েছি । কাগজটা পাঠাইয়া দিয়েছি রেণু'র কাছে এডভোকেটদের সাথে পরামর্শ করে যে কোনো একজন ভাল এডভোকেট দিয়ে মামলা পরিচালনা করতে। এতগুলি বক্তৃতার মামলা দিয়েছে। দুইটায় সাজা হয়েছে, একটায় খালাস পেয়েছি, তার বিরুদ্ধেও আপীল করতে সরকারের কত উৎসাহ। যদিও এডভোকেট সাহেব টাকা নেয় না, তথাপি নকল ও অন্যান্য খরচ বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। জেলে আছি উপার্জন নাই । ছেলেমেয়েদের খুবই অসুবিধা হবে। লড়তে হবে, উপায় কি? রাজনৈতিক কারণে মানুষ মানুষকে অত্যাচার করে তবে তার একটা সীমা আছে ও লজ্জা আছে । নিশ্চয়ই জনগণ বুঝতে পারে যে একটা লোককে ধ্বংস করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার নিশ্চয়ই জানে 'যার কিছুই নাই তার আবার কিছু নষ্ট হবার ভয় কি?' একটা 'দোয বোধ হয় আমার আছে সেটা হলো জনগণ আমাকে ভালবাসে এবং যে ৬ দফা দাবি করেছি তাহা সমর্থন করে, তাই বোধ হয় এই অত্যাচার। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোনো ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে । অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভাল করে জানেন । জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।

 

শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে । একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা । জেলা ও মহকুমার সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে । সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে একটিং সভাপতি ও এক্টিং সম্পাদক রেনুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও । আমার আপত্তি নাই।

 

আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে । তাজউদ্দীন, মোমিন সাহেব, ওবায়দুল, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে রাজি নয়। খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সে পিডিএমএর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারন কমিলায় আছে । তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নুরে আলম, নূরুল ইসলাম--আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিত নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না মানিক ভাই ও পিডিএম এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএম দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের মানস পুত্র বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই—তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে । পূর্ব বাংলার লােকেদের ধােকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী। ৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না । ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না আমার জানা আছে। মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি পিডিএম এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া কোনো আপোষ হবে না। জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন। আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই। এও বলেছি এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা যেন সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোন আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা। হয়েছে।

 

ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আব্দুর রশিদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএফ এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। তারা সভায় যােগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায় ৬ দফার আর প্রয়োজন নেই তাদের কাছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর