• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

করোনাকালে বোরোর বাম্পার ফলন

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২০  

প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) বিশ্বজুড়ে স্থবির পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও মানুষের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে শিল্প-অর্থ-বাণিজ্য সব কিছুতেই এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল দেশে প্রধান উৎপাদান খাত কৃষিতে। সরকারের দ্রুত কার্যকর কিছু পদক্ষেপের ফলে কৃষির বড় বিপত্তি কাটিয়ে এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দেশের কৃষকরা। পরিস্থিতির শুরুর দিকে যেখানে জমিতে থাকা বোরো ধানের পরিণতি নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন কৃষি খাতের সংশ্লিষ্টরা, সেখানে এখন রীতিমতো বোরোর বাম্পার ফলনের খবর মিলছে দেশজুড়ে। এমনকি করোনাভাইরাসের ভেতরই আবার আগাম বন্যার আশঙ্কায় মুষড়ে পড়া হাওরের মানুষের মুখেও এখন হাসি ফুটেছে। এরই মধ্যে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক নিয়ে হাওরের ধান কাটায় মিলেছে নজিরবিহীন সাফল্য। বিশেষজ্ঞরা এমন বিষয়কে এবারের কৃষির জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাফল্য বলেই মনে করছেন।

 

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, এরই মধ্যে হাওরের ৯০ শতাংশের বেশি বোরো ধান কাটা হয়েছে। অন্য এলাকায়ও একইভাবে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক না পেলে যন্ত্র ব্যবহার করে সময়মতো ধান কাটা হবে।

 

গতকাল মন্ত্রণালয়ে এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে কৃষিমন্ত্রী জানান, করোনাভাইরাসের কারণে বোরো ধান কাটার শ্রমিকের অভাব থাকায় হাওরাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এই সাতটি জেলার ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার সরবরাহের বরাদ্দ প্রদান করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বর্তমানে হাওরাঞ্চলে ৩৬২টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ১০৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এ ছাড়া পুরনো মেরামতযোগ্য ২২০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ৪৮৭টি রিপার অতি দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে চলতি বোরো মৌসুমে দেশে মোট ৪৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৯ লাখ হেক্টরে হাইব্রিড, ৩৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে উফশী ও ২৯ হাজার হেক্টরে স্থানীয় জাতের বোরো আবাদ করা হয়। অন্যদিকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় হেক্টরপ্রতি গড়ে ৪ দশমিক ২০ মেট্রিক টন করে মোট দুই কোটি লাখ টন। পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যায়, আগের কমপক্ষে তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এবারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের কাছাকাছিই রয়েছে। গত বছর উৎপাদন ছিল হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ১৫ টন করে মোট দুই কোটি তিন লাখ ৮৮ হাজার টন।

 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. হারুন অর রশিদ বলেন, এবারের বোরোতে যে পরিমাণ জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যসাত্রা ছিল তা পূরণ হয়েছে। আবার আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। অর্থাৎ ফলনও বাম্পার হয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—এই ফলন ঘরে তোলা। সে ক্ষেত্রেও সরকারের বেশ কিছু ভালো উদ্যোগের সুফল আমরা হাওরাঞ্চলে দেখলাম। অন্য জায়গায় এখনো আরো প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি আছে ধান কাটার। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে যেভাবে বোরো ধান কাটার উত্তোলন প্রক্রিয়া চলছে তাতে আমরা আশা করতেই পারি—এবার বোরোর বাম্পার ফলন পাব।

 

শেরপুর খামারবাড়ির উপপরিচালক ড. মোহিত কুমার দে বলেন, ‘জেলায় এবার ৮৯ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। এবার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চালের আকারে তিন লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন। ধানের যা অবস্থা তাতে বাম্পার ফলন আশা করছি।’

 

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পিকন কুমার সাহা জানান, ১৮ লাখ টাকা মূল্যের কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রটি ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে স্থানীয় এক কৃষক ৯ লাখ টাকায় কিনেছেন। সদরে এ ধরনের ৯টি কম্বাউন্ড হারভেস্টারসহ জেলায় ৩৩টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া হয়েছে। যাতে শ্রমিক সংকটের এই সময় সাশ্রয়ে এবং অল্প সময়ে কৃষকরা তাঁদের পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে পারেন। তিনি বলেন, কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনে ধান কাটার সঙ্গে মাড়াই এবং এবং ঝাড়াইসহ বস্তাবন্দি করা যায়। কৃষকের জন্য এ যন্ত্রে ধান কাটা খুব সুবিধা। এ যন্ত্রের মাধ্যমে এক একর জমির ধান কাটতে সময় লাগে মাত্র দেড় ঘণ্টা এবং খরচ হয় মাত্র ছয় হাজার টাকা। কৃষকরা স্থানীয়ভাবে যোগাযোগ করে কিংবা কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে তাঁদের ধান কাটার ব্যবস্থা করা হবে।  

 

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাসরুর জানান, প্রণোদনার আওতায় চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১৩টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গায় শ্রমিক সংকট দেখা দিলেও কোনো সমস্যা নেই। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অল্প সময়ে ধান কেটে কৃষক ঘরে তুলছে পারবেন।

 

সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সফর উদ্দিন জানান, জেলায় মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৮৮ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে।

 

হবিগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তমিজ উদ্দিন জানান, সোমবার বিকেল পর্যন্ত জেলার ছয়টি উপজেলার হাওরাঞ্চলের ৯৬ শতাংশ ও উঁচু এলাকার ৬০ শতাংশ জমির বোরো ধান করা সম্পন্ন হয়েছে। বাকি পুরো আজ কালের মধ্যেই কাটা শেষ হবে। এ ক্ষেত্রে ফলনও ভালো হয়েছে।

 

এদিকে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে খুশি কৃষকরাও। কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রে ধান কাটার ব্যাপারে শেরপুরের কৃষক আব্দুল হাই বলেন, ‘এই যন্ত্র তো আগে দেহি নাই। ধান কাইট্টা, মাড়াই হইয়া এক্কেবারে ধান বস্তায় ভইরা দেয়। খড়গুলাও সুন্দর হইয়া ক্ষেতে বিছানো থাকে। এক একর জমির ধান কামলা (শ্রমিক-মজুর) দিয়া কাটতে কম কইরা হলেও ১২ হাজার টাকা লাগে। আবার মাড়াই করতে তিন হাজার টাকা। সময়ও লাগে বহুত। কামলাও সুময়মতো মিলে না। আর যন্ত্রে সময়ও কম লাগে, টাকাও কম, ঝামেলাও কম।’

 

আরেক কৃষক অহেদ আলী (৫৪) মিয়া বলেন, ‘যন্ত্র দিয়া ধান কাটুন যায় হুনছি। আইজ নিজের চক্ষে দেখলাম। আমারও দেড় একর জমি আছে। যন্ত্র দিয়াই ধান কাটামো বইল্লা অহন চিন্তা করতাছি।’

 

অন্যদিকে গাইবান্ধার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলার সাতটি উপজেলায় মোট এক লাখ ৩০ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ ও সেখান থেকে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টন চাল পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে অনুসারে চাষাবাদ করায় ফলনও ভালো হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে ধান কাটার তোড়জোড়। যদিও এ ক্ষেত্রে খরচ ও শ্রমিক নিয়ে কৃষকদের অনেকের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ আছে। 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর