• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

গতি বাড়ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজে

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২০  

নদী, রেল এবং সড়ক এই তিনমুখি পথেই থাকবে যোগাযোগের সুবিধা। জাহাজ নোঙর, বহিঃনোঙরের জন্য জোয়ারের অপেক্ষা করতে হবে না। কারণ সাড়ে ১৮ দশমিক ৫ মিটার থাকবে বন্দরের প্রবেশ মুখের নদীর গভীরতা। পাশপাশি থাকবে কন্টেইনার বহনে সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা। ২০২৬ সালে যাত্রা শুরুর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে নির্মাণকাজে সাময়িক ব্যহত হলেও এখন পুরোদমে কাজ চলছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার লবণমিশ্রিত মাটির এলাকা মাতারবাড়ি। বঙ্গোপসাগর উপকূলের সেই লবণমাটি খনন করে জাহাজ চলাচলের জন্য তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম নৌপথ। ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য আর ৩৫০ মিটার প্রশস্তের এই নৌপথ দিন রাত খনন করে চলেছে বিশ্বের অন্যতম বড় এবং ভারি খননযন্ত্র 'ক্যাসিওপিয়া'। এই নৌপথে প্রবেশ মুখের ডান দিকে নির্মিত হবে দেশের প্রথম মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের টার্মিনাল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রথমধাপে রয়েছে দুটি টার্মিনাল। সাধারণ পণ্যবাহী ও কনটেইনার টার্মিনালে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) নোঙড়ের সুবিধা। যা গভীরতা স্বল্পতার কারণে এখন দেশের কোনো সমুদ্র বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। প্রথম ধাপে বন্দর ও পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক নির্মাণসহ খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। ২০২৬ সালে প্রথম ধাপের কাজ শেষ হবে। নির্মাণের প্রথমপর্যায়ে কন্টেইনার টার্মিনালটি ১৮ হেক্টর জমিতে নির্মিত হবে এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ বার্থ থাকবে। এটি ৮ হাজার টিইইউ জাহাজ ধারণ করতে পারবে এবং বার্ষিক ক্ষমতা ৬ লাখ থেকে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইউই হবে। পরে কন্টেইনার টার্মিনাল প্রসারিত করা হবে। ৭০ হেক্টর জমিতে এই পর্যায়ে একটি ১ হাজার ৮৫০ মিটার বার্থ থাকবে। বার্ষিক ক্ষমতা হবে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। দ্বিতীয় ধাপে তিনটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মিত হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে টার্মিনালের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রশাসন ও পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য মো. জাফর আলম জানান, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরটি দেশের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক আন্তর্জাতিক মানের একটি সমুদ্রবন্দর।

বর্তমানে পুরোদমে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে তৈরি করা হচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। ১৯৬২ সালে জাপানের একটি ধানখেতে এই কাশিমা বন্দর নির্মাণ করা হয়। কাজ শেষ করে চালু হওয়ার পর সেটি জাপানের ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর ঘিরে এ অঞ্চলের ব্যবসা- বাণিজ্য গড়ে উঠবে।’

সূত্রে জানা গেছে, গভীর সমুদ্রে বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মহেশখালীর সোনাদিয়ায় প্রকল্প নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। সে লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে 'সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন' এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদনও দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের আগস্টে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রস্তাবিত এলাকার মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলার মাতারবাড়ি এলাকায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য একটি জেটি নির্মাণ করতে গিয়ে সমীক্ষায় দেখা যায় ওই জায়গা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের যুৎসই। তারপর এ বছরের মার্চে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি মাতারবাড়িতে নির্মাণে একনেক বৈঠকে অনুমোদন পায়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যেহেতু মাতারবাড়ি যেহেতু গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উপযোগী স্থান, তাই সোনাদিয়ায় আর বন্দর নির্মাণের প্রয়োজন নেই। তাই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে চলতি বছরের গত ১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে আট বছর আগের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হয়।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে এখন গড়ে প্রতিটি জাহাজে ১ হাজার ৮৭৮ টি কন্টেইনার পণ্য আনা-নেওয়া হয়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে এ রকম চারটা চলাচলকারী একেকটি জাহাজে সমান কন্টেইনার আনা-নেওয়া সম্ভব হবে। সামগ্রিক পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় সুবিধা মাতারবাড়ি বন্দর সড়ক, রেল ও নদীপথ দিয়ে সংযুক্ত থাকবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি সুপরিকল্পিত কানেক্টিভিটি গড়ে উঠবে। যার ফলে যে কোনো পণ্য সহজে এবং কম খরচেই পৌঁছে যাবে আমদানি-রফতানিকারকদের দোরগোড়ায়।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। এর ডিজাইন ও লে- আউটসহ সব নকশ জাপানি বিশেষজ্ঞদের তত্তাবধায়নে করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনে সংযোগ সড়কসহ। গভীর সমুদ্র বন্দরে ৩ শ থেকে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬ সালের নভেম্বরে গভীর সমুদ্রবন্দরটির বহুমুখী টার্মিনাল কন্টেইনার জাহাজের জন্য প্রস্তুত হবে। তবে এর আগেই ২০২২ সালের আগস্টের মধ্যে একটি কয়লা টার্মিনালও নির্মাণ শেষ করা হবে। মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের নির্মাণকাজে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ সহায়তা দেবে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। আর নিজস্ব তহবিল থেকে চার হাজার কোটি টাকা দেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের এ মেগা প্রকল্পের কাজ এখন পুরোদমে চলছে। এরইমধ্যে ডিপিপি অনুমোদন পেয়ে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জাপানের নিপ্পন কোয়ে যৌথ কোম্পানি এবং জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড যৌথ কোম্পানি দুটিকে প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিপ্পন কোয়ে প্রকল্পের যাবতীয় ডিজাইন, ব্যয় নির্ধারণ, টেন্ডার ডকুমেন্টস তৈরি এবং অবকাঠামোগত নির্মাণের বিষয়গুলো মনিটরিং এবং তদারকি করবে। পরবর্তীতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ থেকে শুরু করে বন্দর চালু করে দেওয়ার বিষয় সমন্বয় করবে। বন্দর চালু হওয়ার এক বছর পর্যন্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাপোর্ট দেবে। এ জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে ২৩৪ কোটি টাকা দেওয়া হবে।

আর ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের (বন্দর সংযোগ সড়ক অংশ) সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের কার্যক্রম সংক্রান্ত পরামর্শ দেবে। সে জন্য এই কোম্পানিকে দেওয়া হবে ৪৬৬ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই কার্যক্রম প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি আরেকধাপ বাড়িয়েছে।

নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, সমুদ্র সম্পদ ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। মাতারবাড়ি বন্দর বাস্তবায়ন মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর