• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

গোপালপুর হাসপাতাল টাঙ্গাইলে শ্রেষ্ঠ

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

শেষ রাতে প্রসব বেদনা দেখা দেয় জুলেখা বেগমের। স্বামী উজ্জল মিয়া স্ত্রীকে নিয়ে বেকায়দায় পড়েন। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজলা সদর থেকে ১৩ কিলো দূরে অজঁপাড়াগাঁ চাতুটিয়ায় তার বাড়ি। উপজেলা হাসপাতালে আসতেও লাগে বেশ সময়।

ভাড়া রিকসাভ্যান করে উপজেলা সদরে আসতেই বেসরকারি ক্লিনিকের দালালরা ছেঁকে ধরেন। একটি বহুতল সাদা বিল্ডিং দেখিয়ে এক দালাল বলতে থাকেন- ওটি গোপালপুর পৌরশহরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও দামি বেসরকারি হাসপাতাল। নামিদামি ডাক্তার ও নার্সরা ওখানে বসেন। অতিযত্নে সিজার করেন। সিজারে সূঁইফোঁটানো ব্যাথাও পাবেনা প্রসূতি। ছেলেকে মেয়ে আর মেয়েকে ছেলে বানিয়ে দেয়া ছাড়া সব পারেন ওখানকার ডাক্তার ও নার্সরা। ওখানে সিজার করালে বাচ্চার কখনো নিউমোনিয়া হবেনা। পরবর্তীতে হাম, জলবসন্তসহ কোন ছাঁয়াচে রোগ কাছে ভিড়বেনা। চিকিৎসায় সব বিদেশী ওষুধ ও সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়। সিজারের পরে প্রসূতি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পান। ঝকঝকে তকতকে কেবিন। একদম করোনা প্রুফ। 

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ ভালো নয়। সেখানকার ডাক্তাররা রোগীর কেয়ার করেননা। মানসম্মত ওষুধ দেননা। সব বাইরে থেকে কিনতে হয়। সেখানকার খাবার মুখ রোচেনা। সরকারি হাসপাতাল মানেই করোনা ছড়ানোর ডিজিটাল মেশিন। এমন সব ব্যক্ততাজারির পর রিকসাভ্যান আগলে ঠেলেঠুলে ওই ক্লিনিকের দিকে নিতে থাকনে এক দালাল। ইতিমধ্যে মধ্যবয়সী ওই দালালের সাথে দুই বাচ্চাদালাল ভ্যান ঠেলার কাজে যোগ দেন।

এক মুহুূর্ত ঘোরের মধ্যে কাটানোর পর স্তম্ভিত ফিরে পান উজ্জল মিয়া। মনে জোর ফিরিয়ে এনে ধমক দেন। বলতে থাকেন, ‘‘ছাড়ো বাপু ছাড়ো। আমি ক্লিনিকে যাবোনা। শুনেছি সরকারি হাসপাতালে এখন ভালো চিকিৎসা হয়। মাগনা ওষুধপত্রও দেয়। সেখানকার বড় ডাক্তার সাহেব নাকি খুব ভালো মানুষ। ডাক্তার হিসাবেও নাকি তিনি খুব ভালো। কাজেই গেদার মাকে আমি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাবো। তোমরা ভ্যান ছাড়ো।’’ 

উজ্জল মিয়ার চোখমুখের ক্রুরতা দেখে দালালরা ভড়কে গেলো। একরাশ হতাশায় রিকসাভ্যান ছেড়ে দিয়ে পাশে দাড়ালো। আর ভ্যানচালক ত্রিচাকার যানটি ঘুরিয়ে প্রধান সড়ক ধরে উপজলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়।

এটি কোন গল্প নয়। গ্রামের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ উপজেলা সদরে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে বেসরকারি ক্লিনিকের খুদে বনিয়াদের দ্বারা কিভাবে বিড়ম্বিত ও হয়রানি হন তার চালচিত্র এটি।

উজ্জলের বাবার নাম আব্দুস কদ্দুস। নয় বছর আগে জুলেখা বেগমকে বিয়ে করেন। গত রবিবার ১৫ ফেব্রুয়ারি গোপালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আলীম আল রাজী লিটনের সহযোগিতায় উজ্জল মিয়া প্রসূতি স্ত্রী জুলেখা বেগমকে গোপালপুর হাসপাতালে ভর্তি করান। প্রয়োজনীয় চেকআপের পর ওই দিনই গোপালপুর হাসপাতালের গাইনীর ডাক্তার নীলু শারমীন চৌধুরী এবং এনেসথেসিষ্ট ডাক্তার তসলিম উদ্দিন ফারুখী সীজার অপারেশন করেন। জুলেখা পুত্র সন্তান লাভ করেন। 

প্রসূতি ও সন্তান সুস্থ থাকায় শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) উভয়কে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়।

সাত বছর আগে জুলেখা বেগম গোপালপুর পৌর শহরের এক বেসরকারি ক্লিনিকে দশ হাজার টাকার চুক্তিতে সীজারিয়ান অপারেশন করে প্রথম পুত্র সন্তান লাভ করেন। প্রথম পুত্রের নাম আবদুর রহমান জীম। আর সদ্যপ্রসূত পুত্রের নাম রেখেছেন জীসান আহমেদ।

জুলেখা বেগম জানান, “সাত বছর আগে বেসরকারি ক্লিনিকে প্রথম সীজার অপারেশন শেষে ছাড়া পাওয়ার পর তলপেটে অনবরত ব্যথাসহ নানা উপসর্গে ভুগেছি। ওই অপারেশনের পর ক্লিনিকে কোন যত্নআত্তিও পাইনি। কিন্তু এবার সরকারি হাসপাতালে সীজারের পর ডাক্তার ও নার্সরা সর্বক্ষণ খোঁজখবর নিয়েছেন। কিছু ওষুধ নিজের কিনতে হয়েছে। বাকিটা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নিজের খরচ পড়ছে হাজার দুয়েক টাকা। এখন বেশ সুস্থ আছি। ভালো আছি।”

সরজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালে প্রথম দফা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গোপালপুর হাসপাতালে প্রথম সীজার অপারেশন শুরু হয়। মাত্র তিন বছর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর এই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পদে যারাই এখানে চাকরিতে এসেছেন, দুইএকজন বাদে তাদের সবাই তিন থেকে ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হননি। 

রাজনৈতিক হানাহানি, হাসপাতালে হামলা, মারামারির রোগীর সনদ পাওয়া নিয়ে ডাক্তারদের উপর অবাঞ্জিত চাপাচাপি, আবাসিক কোয়ার্টারের দুরবস্থা তথা সার্বিক পরিস্থিতি চিকিৎসা সেবার প্রতিকূলে থাকায় মেডিক্যাল অফিসাররা এখান এসেই অন্যত্র বদলী হওয়ার ধান্ধায় থাকতেন।

এক পর্যায়ে গোপালপুর উপজেলা হাসপাতাল একটি কথিত গার্ভেজে পরিণত হয়। দুই বছর আগে ডাক্তার আলীম আল রাজী লিটন এখানে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে যোগদানের পর হাসপাতালের সামগ্রিক পরিবেশ বদলাতে থাকে। 

 সুদীর্ঘ দুই দশক পর গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে পুনরায় সীজার অপারেশন শুরু হয়। বিত্তহীন ও দরিদ্র প্রসূতিরা এখন বিনা খরচায় সীজার অপারেশনের সুযোগ পাচ্ছেন। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ৬৫টি সীজার অপারেশন হয়েছে। প্রত্যেক শিশু ও প্রসূতি সুস্থ্য রয়েছেন। পাশাপাশি স্বাভাবিক প্রসবের জন্য স্বাস্থ্য কর্মীরা কাজ করছেন। শুধু শারিরীক জটিলতা থাকলেই সীজার করার ব্যবস্থা হচ্ছে। 

হাসপাতালে ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম, ডিজিটাল এক্সরে অটো এনালাইজার, জিনএক্সপার্ট এক্সরেসহ চিকিৎসায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহার হচ্ছে। হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

আগে প্রতিমাসে  তিনচার হাজারের বেশি রোগীর আগমন ঘটতোনা। এখন সেখান নয়-দশ হাজার রোগী সেবা নিতে আসছেন। হাসপাতাল সুসজ্জিত মুক্তিযোদ্ধা কেবিন, বিশেষায়িত কেবিন, আউটডোর রোগীদের বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, ডাইনিং হল এবং ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের পৃথক নিজস্ব রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতালের সামনে করা হয়েছে ফুলের বাগান। বিষাক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য আলাদা কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। 

চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের জন্য টাঙ্গাইল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ গোপালপুর উপজেলা হাসপাতালকে শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল এবং ডাঃ আলীম আল রাজী লিটনকে জেলার শ্রেষ্ঠ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নির্বাচন করেছেন।

এদিকে টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডাঃ এ এফ এম শাহাবুদ্দীন খান গত বহস্পতিবার গোপালপুর উপজলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যক্ষারোগী সনাক্তের জন্য অত্যাধুনিক জীন এক্সপার্ট এক্সরে মেশিন উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে গোপালপুর হাসপাতালের চিকিৎসার মান ও সামগ্রিক পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা জানান। 

এ সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন বিএম এ টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি ডাঃ সৈয়দ ইবনে সাঈদ এবং গোপালপুরের কৃতি সন্তান ও বিএম এর সম্পাদক ডাক্তার শহিদুল্লাহ কায়সার, প্রেসক্লাব সভাপতি জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আলীম আল রাজী জানান, এটি ৩১ শয্যার হাসপাতাল। লোকবল ও সেইরকম। কিন্তু সেবা দিত হহচ্ছে ৫০ শয্যার হাসপাতালের মতো। তাই চিকিৎসা সেবা দিতে সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। ভবন সংকট দূর করা দরকার। হাসপাতালে বাউন্ডারী দেয়াল না থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে সংকট রয়েছে। কোয়ার্টার গুলো ভাঙ্গাচুরা। থাকার অনুপযোগী। এসব সত্বেও কর্তব্যরত স্টাফরা কাজ করে যাচ্ছেন।

স্থানীয় এমপি জনাব ছোট মনির, উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক এবং মিডিয়ার কর্মীরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি। তিনি গোপালপুরবাসির সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর