• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

জাতিসংঘ অধিবেশনে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলার মানুষ পেয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। শৈশব থেকে তিনি ছিলেন জনদরদি। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বুঝতেন সবসময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। যৌবনে তিনি পুরোদমে হয়ে উঠলেন ছাত্রনেতা। রাজনীতি অঙ্গনে সক্রিয় হলেন। সাধারণ জন মানুষের দাবি-দাওয়া আদায়ে তিনি বারবার আন্দোলনে নামলেন। মানুষ তাঁকে হৃদয়ের আসনে বসাল। শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন মুজিব ভাই। ভালোবেসে তাঁকে সাধারণ মানুষ বলত শেখ সাহেব। শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু থেকে এল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া লাল সবুজের বাংলাদেশ। 

 

১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এ ঘোষণা বাংলাদেশের মানুষকে আনন্দিত করেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অনেক আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি খুসী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হওয়া বাংলাদেশের জন্যে সন্দেহ অতীতভাবে গৌরবময় প্রাপ্তি। 

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন। এটি ছিল জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশন। অধিবেশনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। এসময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ২৪ জন। এঁদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও অয়েল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, এমআর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ ছিলেন। লন্ডনে যাত্রা বিরতি শেষে তারা নিউইয়র্কে জে এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।

 

বাংলাদেশের জন্যে আরেকটি গৌরবজনক ঘটনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষণ প্রদান করা। তাঁকে ইংরেজিতে ভাষণ দেয়ার আহ্বান জানালে তিনি বলেন, আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তব্য রাখতে চাই। বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ঠিক হয়েছিল তাঁর বক্তব্য তাৎক্ষণিক ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠ করবেন ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরী। তিনি স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘‘২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ নিউইয়র্কের জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় প্রদত্ত বক্তৃতার অনুবাদ যুগপৎভাবে ইন্টারপ্রিটারের বুথ থেকে পাঠ করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হলো। আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সঠিকভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারব তো? অভয় দিলেন বঙ্গবন্ধু। হোটেলে তাঁর কামরায় বার তিনেক রিহার্সেল দিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সিংহভাগ মানুষ তো তোমার ইংরাজি অনুবাদই শুনবে। অতএব বক্তৃতা পড়ার সময় তুমি নিজেকেই প্রধানমন্ত্রী ভাববে।’ তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘অবশ্য তা কেবল বক্তৃতা পড়াকালীন সময়ের জন্য!’ দিন শেষে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘শাবাশ, শুনেছি ভালোই হয়েছে তোমার বক্তৃতা!’ আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এর চেয়ে স্বস্তিদায়ক প্রশংসা কোনো দিন পাইনি।’’

 

জাতিসংঘে স্বভাবসুলভ সুচিন্তিত বক্তব্য রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত রহিয়াছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন।’’ বঙ্গবন্ধু এর মাধ্যমেই তুলে ধরলেন বাঙালির সংগ্রামের কথা। শ্রদ্ধা জানালেন শহীদদের প্রতি। জানালেন বাঙালির শক্তির স্তম্ভের কথা। বললেন, ‘‘বাংলাদেশের মতো যেই সব দেশ দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, কেবল তাহাদেরই এই দৃঢ়তা ও মনোবল রহিয়াছে। মনে রাখিবেন সভাপতি, আমার বাঙালি জাতি চরম দুঃখ ভোগ করিতে পারে, কিন্তু মরিবে না, টিকিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার জনগণের দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান শক্তি।’ এসবের পাশাপাশি বিশ্ববাসীর কাছে জানালেন বাংলাদেশের লক্ষ্যের কথা। জানালেন অন্তরায়। জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশের শক্তি কাঠামো সৃষ্টি করিয়াছে।... আমরা শান্তি চাই। আর কেবল এই জন্যই অতীতের সকল গ্লানি ভুলিয়া যাইয়া পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি।... শান্তির জন্য ইহা আমাদের একটি বিনিয়োগ বলিতে পারেন।’...‘জাতিসংঘের সাফল্য ও সম্ভাবনার যে দিক বাংলাদেশ উপলব্ধি করিয়াছে, আর কেউ তেমনটি করিতে পারে নাই।’ এভাবেই ৪৫ মিনিট বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখেন। বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে স্বাগত জানাল উপস্থিত বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের প্রশংসা খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ।’

 

সাধারণ অধিবেশন শেষে ২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করেন। সফরসঙ্গী তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাম্ফীতিজনিত সমস্যা এবং বাংলাদেশে সর্বনাশা বন্যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে স্বদেশের প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার পর জাতিসংঘ বাংলাদেশের ত্রাণকার্যে ৭০ লাখ ডলার সহায়তা প্রদান করে। পাশাপাশি উপমহাসচিব ড. ভিক্টর উমব্রাইখটকে বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি বিশেষ নজর রাখার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। (সূত্র : জাতিসংঘে জাতির পিতার বাংলা ভাষণ/ তোফায়েল আহমেদ)।

 

বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘ অধিবেশনে সে দিনের যোগদান যে শতভাগ সফল ও স্বার্থক হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধু বিশ্বনেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বক্তব্য রেখেছেন শহীদদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষায়। এর মাধ্যমে আপামর বাংলার মানুষ বিশ্ব দরবারে কথা বলল যেন। আর বিশ্ব নেতৃবৃন্দও কাছ থেকে দেখতে পেল সংগ্রামী নেতা বঙ্গবন্ধুকে। সম্প্রতি জাতিসংঘ বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্যে অনেক আনন্দের ও গৌরবের। 

 

জাতির জনকের মতো তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন। ওই ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে বলেছেন, ‘‘আজ থেকে ২২ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাধারণ পরিষদের এক মহান অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, জাতির জনকের কন্যা হিসেবে এই অনন্য বিশ্ব ফোরামে বক্তব্য রাখার বিরল সম্মান ও সুযোগ আমাকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে। ইতি মধ্যে বিশ্বে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, পুরনো আদর্শভিত্তিক বিভক্তি ভেঙে পড়েছে, আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিগত দুই দশকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে নতুন শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক জোটের উদ্ভব হয়েছে।...বাইশ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ইস্যুগুলো এখানে উত্থাপন করেছিলেন, সেসব এখনো বিদ্যমান। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি মানবিক ঐক্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতি প্রদান করে মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার যুক্তিপূর্ণ সমাধান ও জরুরি কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলিষ্ঠ যুক্তি উত্থাপন করে বলেছিলেন, জাতিসংঘের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলতে যুক্তির শক্তি যোজনা। এ ব্যবস্থায় স্বীয় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রতিটি দেশের সার্বভৌম অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে।’’ বঙ্গবন্ধুর যথার্থ উত্তরসূরি দেশরত্ন শেখ হাসিনা। জাতির জনকের মতো তিনিও বাংলাদেশের হয়ে বলিষ্ঠভাবে কথা বলছেন বিশ্ব নেতাদের সামনে।  শেখ হাসিনাকেও বিশ্ব নেতারা সমীহ করছে পরম বিস্ময়ে। বঙ্গবন্ধু আদর্শে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর