• বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

জাতিসংঘে বাঙালির মাতৃভাষা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  

জাতিসংঘে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দেওয়ার পর অনেকেই সেখানে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। এখন চেষ্টা চলছে বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষায় অন্তর্ভূক্ত করানোর। এর অগ্রগতি নিয়েই এবারের মূল রচনা।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩০তম অধিবেশনে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বসভায় দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ ছিল বাংলায়। এই প্রথম বিশ্ব সংস্থার কোনো আনুষ্ঠানিক সভায় বাংলা ভাষা ব্যবহূত হলো।
এরপর বাংলাদেশের অনেক সরকারি নেতা-নেত্রী বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবার জাতিসংঘের বার্ষিক বিতর্কে অংশ নিয়েছেন, প্রতিবারই বাংলায় বলেছেন। বিশ্বসভার সরকারি ভাষা ছয়টি—আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও রুশ। সাধারণ পরিষদের মূল ভাষণ যে ভাষাতেই দেওয়া হোক, প্রতিটি সরকারি ভাষায় তার তাত্ক্ষণিক অনুবাদ করার নিয়ম রয়েছে। এ জন্য একাধিক ভাষায় দক্ষ ও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত দোভাষী রয়েছেন, যাঁরা সে ভাষণ শুনে মুখে ভাষান্তর করে দেন। একই সঙ্গে ছয়টি ভাষায় সে ভাষণ শোনা যায়। সরকারি ভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষায় ভাষণ দেওয়া হলে সে ভাষণের অনুবাদ হয় ইংরেজি নয়, ফরাসি ভাষায় আগেভাগে দোভাষীদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষণ বাঙালিদের মনে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। সম্ভবত সে ভাষণের ভেতর দিয়েই আরও বৃহত্তর একটি স্বপ্নেরও জন্ম হয়েছিল। বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে বিশ্বের ২৫ কোটিরও বেশি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। তাহলে বাংলা জাতিসংঘের সরকারি ভাষা কেন হবে না? ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করলে এ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মনে নতুন উত্সাহের সঞ্চার হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা যতবার নিউইয়র্কে এসেছেন, বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেছেন। এ নিয়ে তিনি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জাতিসংঘ মহাসচিব ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের আইন পরিষদে বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দাবি করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
যত আবেগবাহী হোক না কেন, এই প্রস্তাবের বাস্তব কার্যকারিতা খুব কম। বাংলা অথবা অন্য যেকোনো ভাষা জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তা নিয়ে সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হতে হবে। তার আগে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে কী পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন, সে কথা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও সম্মেলনবিষয়ক দপ্তরকে বাজেট প্রস্তাব আকারে সদস্যদের জানাতে হবে। এর কোনোটিই খুব সহজ নয়।
জাতিসংঘের সরকারি ভাষার অর্থ হলো বিশ্ব সংস্থার সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের সব সরকারি নথি সকল সরকারি ভাষায় প্রকাশ। প্রতিবছর শুধু জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকেই লক্ষাধিক পাতার নথি প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ নথির মূল ভাষা হয় ইংরেজি বা ফরাসি—এই দুটি ভাষা জাতিসংঘের ব্যবহারিক ভাষা। কিন্তু মূল ভাষা যা-ই হোক, প্রতিটি সরকারি নথি প্রায় একই সময়ে জাতিসংঘের প্রতিটি সরকারি ভাষায় প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। শুধু নথি নয়, মূল অঙ্গ সংস্থাগুলোর আনুষ্ঠানিক সভায় প্রদত্ত প্রতিটি ভাষণ, প্রতিটি তর্কবিতর্ক সেসব ভাষায় অনূদিত হতে হবে।
জাতিসংঘ যেসব নথি প্রকাশ করে, তার অধিকাংশই জাতিসংঘের আলোচ্যসূচির অন্তর্গত কোনো না কোনো বিষয়ের প্রতিবেদন। পেশাদার কূটনীতিক অথবা গবেষকদের বাইরে প্রায় কেউই সেসব নথির অধিকাংশের খোঁজ রাখেন না। তাঁদের বাস্তব ব্যবহারও সীমিত। তা ছাড়া অধিকাংশ কূটনীতিকই নিজেদের ভাষার বদলে হয় ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় নথিপত্র পড়তে, তা থেকে উদ্ধৃতি দিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এ অবস্থায় যদি আরও একটি ভাষায় জাতিসংঘের নথির অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে সে নথি পড়বে কে? বাংলা ভাষাভাষী কূটনীতিকেরা যে নন, তা বলাই বাহুল্য।
ধরা যাক, কেউ পড়ুক বা না পড়ুক, সব নথি বাংলায় অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখন প্রশ্ন হলো, এই অনুবাদের জন্য যে খরচ, তা বহন করবে কে? এক হিসাবে দেখা যায়, যেকোনো এক পাতা ভাষান্তরের জন্য গড়পড়তা ব্যয় হলো প্রায় দুই হাজার ৫০০ ডলার। জাতিসংঘের সূত্র উদ্ধৃত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জাতীয় সংসদকে জানান, বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা করতে হলে বছরে প্রায় ব্যয় হবে ৫৫ মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ জাতিসংঘের নিয়মিত বাজেট থেকে আসবে। কিন্তু সে অর্থ জোগাতে সদস্য দেশগুলো রাজি হবে তো?
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোমেনকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি যে খুব আশাবাদী, তা মনে হলো না। তিনি জানান, বাংলাকে সরকারি ভাষার প্রস্তাব নিয়ে তাঁরা চিঠি লিখেছেন, সলাপরামর্শ করেছেন। অনেকেই তাঁদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল, তাঁদের দেওয়া যুক্তিও মানেন। কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দে রাজি নন। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো দেশ এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। বাজেট-সংকটে জাতিসংঘের নিয়মিত কার্যক্রম কাটছাঁট করতে হচ্ছে, কর্মীর সংখ্যা কমাতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষা করার দাবি ধোপে টিকবে কি না বলা মুশকিল। ড. মোমেন অবশ্য খুব জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা কিন্তু আশা ছাড়ছি না। চেষ্টাও থামাচ্ছি না।’
শুধু বাংলা নয়, এর আগে জাতিসংঘের সরকারি ভাষা করার জন্য হিন্দি ও জাপানি ভাষার প্রস্তাব তুলেছে ভারত ও জাপান। সে প্রস্তাবকে বড়জোর প্রতীকী বলা চলে। তা নিয়ে দেশ দুটোর কেউই খুব জোর চেষ্টা চালায়নি, যদিও প্রয়োজনীয় অর্থ জোগানো তাদের সাধ্যের বাইরে নয়।
বাংলা ভাষা জাতিসংঘের সরকারি ভাষা হোক বা না হোক, জাতিসংঘের বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর নানা চেষ্টা চলছে। বাংলায় একটি নিয়মিত রেডিও অনুষ্ঠান চালু রয়েছে দীর্ঘদিন। মাঝখানে অর্থের অভাবে সে অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ সরকারের চাপের কারণে সে অনুষ্ঠান নতুন করে চালু হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইট থেকে সে অনুষ্ঠান যে কেউ পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে শুনতে পারেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ও প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়মিত উদ্যাপিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের ভেতর শহীদ মিনারের একটি রিপ্লিকা স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে সলাপরামর্শ চলছে কয়েক বছর ধরে।
বাঙালি কূটনীতিকেরাও বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ‘জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যখনই সুযোগ পাই, আমি বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের মূল লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অনেক কবিতা এই ভবনে উচ্চারিত হয়েছে,’ জানান ড. মোমেন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর