• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

জামালপুরে বিখ্যাত ফটোসাংবাদিকের নাম কানু দা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৮ জানুয়ারি ২০২০  

জামালপুরের সাংবাদিকতার নক্ষত্র রাতের এক ঝিনুক পোকার নাম কানু দা। তাঁর পুরো নাম অজিত সোম কানু। জামালপুরের ইতিহাসে কানু দা ছিলেন একজন বিখ্যাত ফটোজার্নালিস্ট। ৮ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় জামালপুর হাসপাতালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে কানু দার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি দীর্ঘদিন থেকে বার্ধক্য জনিত রোগে ভোগছিলেন। কানু দার মৃত্যুর খবরটা জানতে পারি জামালপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও এটিএন বাংলার শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক লুৎফর ভাইয়ের কাছ থেকে। প্রবীন সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ এবং তাঁর স্ত্রী রহিমা খাতুনকে হত্যা, শফিক জামান লেবুর অকাল মৃত্যুর খবরে আমি ভীষণ ব্যথিত হয়ে ছিলাম। মনের অজান্তেই চোখের পানি ঝরছিল। ঠিক তেমনি কানু দার মৃত্যুর খবরে বুকটা ভারি হয়ে ওঠল। এই প্রজন্ম এই বিখ্যাত ফটোসাংবাদিক কানু দার সম্পর্কে ধারণা নাই বল্লে চলে। কিন্তু কানু দা যে কত বড় মাপের একজন ফটোগ্রাফার ছিলেন; তা বুঝাতে পারবো না। হয়ত মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। সাংবাদিক-সূধিমহল এবং প্রশাসনেও কানু দার কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। তিনি সবারই পরম শ্রদ্ধার লোক ছিলেন। মুসলিম সমাজে একজন হিন্দু বা সনাতন যাই বলি না কেন, কানু দাকে সর্বমহল,  এমনকি আলেম সমাজও সম্মানের চোখে দেখতেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, কানু দা একজন নিরন্তন ভালো মানুষ ছিলেন।

 

 জামালপুরের আরেক নক্ষত্র প্রয়াত সাংবাদিক শফিক জামান লেবুসহ সকল সাংবাদিকের প্রিয়ভাজন ছিলেন কানু দা। লেবু একবার আমাদের কানু দা শীর্ষক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনটি সর্বমহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 

 

অজিত সোম কানু ১৯৪০ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুরের আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম স্বর্গীয় দেবেন্দ্র কুমার সোম। কানু দার নিজেও একজন শিল্প মনা। এমনকি পুরো পরিবারই ছিল শিল্প মনা। কানু দার ছোট্র ভাই বীরেন সোম একজন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। কানু দা ১৯৬৫ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ৫৪ সালে ফটোসাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। কানু দার ছেলে বিশ্বজিত সোম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারু-কারু কলার বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ^জিত সোম বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত আছেন।

 

১৯৬২ সালের চৈত্র মাসে পত্র-পল্লব বিহীন বটবৃক্ষের ‘ঝরাপাতার গান’ কানু’দার আবেগঘন ধূসর ফটোফিচারটি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। সেই ছবির ক্যাপশন লিখে ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী নিজে। ছবিটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইত্তেফাক ছাড়াও আজাদ, মিল্লাত, সংবাদসহ বাংলা-ইংরেজি বহু পত্রিকায় কানু’দার ছবি ছাপা হয়েছে। জামালপুরের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ছবির জন্য একমাত্র কানু’দাই ছিলেন ভরসা। শহীদ সাংবাদিক আহসান উল্লাহ, সুরুজ চৌধুরীর মতো বহু সাংবাদিকরা কানু’দার ছবি নিতেন। কানু দা বিনা পয়সায় সাংবাদিকদের ছবি সরবরাহ করতেন। 

আমার দেখা কানু দা সম্পর্কে বলতে হয়, আমি তখনো নবীন সাংবাদিক। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামালপুরে কয়েকবার আসছিলেন। কানু দা ছবি নিতে যাবেন। কিন্তু নিরাপত্তার কাজে লোকেরা কানু দাকে আটকে দিলেন। এই দৃশ্যটি আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে। তখন হাত উচু করে কানু দাকে প্রবেশের ইঙ্গিত দেন। 

 

অনুরুপভাবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ড আলহাজ হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ জামালপুরে আগমন করেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের জনসভার ছবি তোলার জন্য কানু দা মঞ্চে যান। এরশাদসহ জনসভার একাংশের ছবি এক ফ্রেমে ক্যামেরাবন্দির জন্য প্রেসিডেন্ট এরশাদকে একটু ঘুরিয়ে দাড় করিয়ে ছবি তোলেন। পরদিন সেই ছবিটিই বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। কানু দার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলাম। তিনি বল্লেন, প্রেসিডেন্ট এরশাদের বহুবার ছবি তুলেছি। তিনি আমাকে চিনতেন। তাই এমনটা করা সম্ভব হয়েছিল বলেই হেসে দিলেন। 

 

শফিক জামান লেবু সম্পাদিত সাপ্তাহিক ঝিনাই অফিস ছিল তখন শহীদ হারুন সড়কের আনছারি ম্যানশনে। সেখানেই সাংবাদিকদের আড্ডা থাকতো। বিভিন্ন উপজেলা থেকে সাংবাদিকরা জামালপুরে ফ্যাক্সবার্তা পাঠাতে আসলেও; এই আনছারি ম্যানশনের ঝিনাই অফিস ছিল এক মিলন কেন্দ্র। পরে এম.এ. জলিলের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক জামালপুর সংবাদ কথাকলি মার্কেট থেকে যাত্রা শুরু হয়। জলিলের সম্পাদনায় দৈনিক আজকের জামালপুর, বজলুর রহমান সম্পাদিত সচেতন কণ্ঠ, নূরুল হক জঙ্গীর সম্পাদনায় পল্লীকণ্ঠ ছাড়াও আরো কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কানু দার ছবি সেই পত্রিকাগুলোর চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখে। সকালের নাস্তা সেরেই গোটা জামালপুর শহর ঘুরে বেড়াতেন; ছবি তোলার নেশায়। ছবি তোলার জন্য মাঝে মাঝে শহরের বাইরেও যেতেন। কানু দার এই ঋণ পরিশোধ যোগ্য নয়। এতেই শেষনয়, দ্বিতীয় কানু দার জন্ম হবে কিনা ভবিষ্যতই জানে। যেমন শুন্যতা পূরণ হয়নি শফিক জামান লেবুর।

 

প্রয়াত সাংবাদিক শফিক জামান লেবুর এক প্রতিবেদন এবং মৃত্যুর খবরে ফেসবুকে কানু দার সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান, ’৭০ এর নির্বাচন, ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বহু ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কানু দাকে চিনতেন। 

 

৮ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে জামালপুরের সাংবাদিক মহল কানু দার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই শোকাবহ মুহুর্তে আমি তাঁর স্বর্গীয় আত্মার শান্তি কামনা করছি। প্রকৃত পক্ষে কানু দার কর্মের মুল্যায়ন আমরা কেও করতে পারিনি। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। কেও পাশে দাড়াতে পারিনি বলে আমরাও তাঁর কাছে ঋনী। তাই ক্ষমা করো কানু দা । আমাদের কানু দা...। 

 

লেখক- 

শাহ জামাল,

ইত্তেফাক সাংবাদদাতা,

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেলান্দহ রিপোর্টার্স ইউনিটি, 

জামালপুর। 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর