• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

পতন না হলে মন্ত্রিসভার সদস্যরাও মোশতাকের আ’লীগই করতেন!

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০  

৮৩ দিনের রাজত্বের অবসান না ঘটলে মোশতাকের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ করতেন তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা। আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক '৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং '৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।  এর দু'দিন আগে ১ সেপ্টেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী থেকে এক দলীয় (বাকশাল) পদ্ধতি রহিত করেন। 

তিনি ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে ডাকেন সংসদ সদস্যদের সভা। স্পিকার আবদুল মালেক উকিল সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সংসদ সদস্য ময়েজউদ্দিন আহমদ, অ্যাড. সিরাজুল হক ও  শামসুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে বক্তব্য রাখেন। ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই। তখনও মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছিলেন নির্বিকার। 

২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' জারি করার পক্ষেও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন ছিল। মোশতাকের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে বাহবা কুড়িয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুরও আইনমন্ত্রী ছিলেন। মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা  বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভারই সদস্য ছিলেন।
মোশতাকের মোসাহেবি এমনভাবে শুরু হয় যে, দেশে জাতীয় পাখি আছে, জাতীয় ফুল আছে, জাতীয় ফল আছে, একটা জাতীয় টুপি থাকা দরকার। অতএব একটা জাতীয় টুপির পক্ষে মন্ত্রিসভার অনুমোদন মিললো। গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপি যে টুপিটা খন্দকার মোশতাক পরিধান করেন। সংসদ ভবনসহ সমস্ত সরকারি দফতর থেকে বঙ্গবন্ধু ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয় ২৬ আগস্ট। মন্ত্রিসভার কোন সদস্য সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেনি। বরং শপথ গ্রহণের পর কে কোন দফতর পাবেন সেনিয়ে মোশতাকের সমীহ আদায়ের চেষ্টা করেন। যে কারণে পূর্বের দফতরগুলো তাদের মাঝে বন্টন করা হয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু বাকশাল মন্ত্রিসভার ভিত্তিতে দফতরগুলো র্বন্টন করা হয়।

মন্ত্রিসভা গঠনের ৮ দিনের ব্যবধানে (২৩ আগস্ট) গ্রেফতার করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ এবং ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও  গাজী গোলাম মোস্তফাকে। এসব গ্রেফতার নিয়েও কী  মন্ত্রিসভার কোন সদস্য মুখ খুলেছিলেন?  রাষ্ট্রপতি মোশতাক কী গ্রেফতারের আগে তার মন্ত্রীদের পরামর্শ নেননি? 
 
সংসদ সদস্যদের  বৈঠক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার 'রাজনীতির তিনকাল' গ্রন্থে  লিখেছেন, "একদিন খন্দকার মোশতাক আমাকে ইফতারের দাওয়াত দিলেন। ইফতারের পর বললেন, "তোমাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তুমিও যদি দেশের রাষ্ট্রপতি হও তাহলে তোমারও দেশ পরিচালনার জন্য ৫০ জন লোক লাগবে।" জবাবে বললাম, মোশতাক ভাই আপনি তো বলেছেন আওয়ামী লীগ করবেন। তাই আমাকে দলের জন্যই রাখেন। সরকারে টানার দরকার নেই। 

'৬৬-৭২ আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী নেতাদের গ্রেফতারের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গভবনের সভায় বলেছিলেন, "যেভাবে নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে, তাতে দল করবেন কাদের নিয়ে? বাস্তবতা ছিল মোশতাকের ৮৩ দিনের রাজত্বে একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। পতন না হলে তারা কি মোশতাকের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ করতেন? 

মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, "আপনারা কেউ লাশের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যেতে চাইলে যেতে পারেন।" কিন্তু মোশতাক দেখলেন কেউই যেতে আগ্রহী নন।  মোশতাকের পতনের চার বছর পরও তাদের কেউ বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়ায় যাননি। এটাই ছিল নির্মম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা। যদিও খন্দকার মোশতাকের আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আর হয়নি। তিনি ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। '৭৬ সালে পল্টন ময়দানে তার জনসভায় কে বা কাহারা অতর্কিত সাপ ছেড়ে দেয় এবং ঘটে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। ৯ জন এতে মারা যায়। 

৭৬ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের পর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন নেতৃত্বলাভ করেন। পরে স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের হাতে চলে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আব্দুর রাজ্জাক কারাগারে বসে সাধারণ সম্পাদক হন। মালেক উকিল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান শেষে লন্ডনে যাত্রা বিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশ ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।"

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করার পরও আবদুল মালেক উকিল কি করে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন তার জবাব কে দেবেন? 

'৭৯ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় সংসদ গঠিত হলে মোশতাকের নৌ জাহাজ চলাচল মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন।
মোশতাকের মন্ত্রীদের মধ্যে ফণিভূষণ মজুমদার, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, সোহরাব হোসেনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির শীর্ষে অবস্থান করেন। 
অপরদিকে, মোশতাকের অর্থমন্ত্রী ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক, শিক্ষামন্ত্রী ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী মোশতাকের পতনের পর নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

পরিকল্পনা মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগ (মিজান) এর সাধারণ সম্পাদক হলেও পরে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হন। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু সরকারের নৌ জাহাজ চলাচল মন্ত্রী জেনারেল এম এ জি ওসমানী মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন দেয়।  

প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগে ফেরেন। বিএনপিতে পাড়ি জমান কেএম ওবায়দুর রহমান, রিয়াজুদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। আর  জাতীয় পার্টিতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম চৌধুরী সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোসলেম উদ্দিন খান ও মোমেন উদ্দিন আহমেদও মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছাড়া মোশতাক মন্ত্রিসভার কেউ বেঁচে নেই। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর