• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

পাঠ্যবই ছাপায় ৩০০ কোটি টাকা সাশ্রয়

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২০  

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যের বই ছাপায় বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপায় নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম দামে দরপত্রে অংশ নিয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে সরকারের বিশাল অঙ্কের এ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। বৈশ্বিক করোনা মহামারির মধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এ টাকা সাশ্রয়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তবে কম দামে কাজ দিতে গিয়ে বইয়ের মানে যেন ধস না নামে সেদিকে নজর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মুদ্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজ তৈরির পার্লপের দামে অস্বাভাবিক দরপতন, গেল বাজেটে কাগজের ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট (২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ) কমানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নোট গাইড ও প্রকাশনা শিল্প বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী রপ্তানি বন্ধ থাকায় টনপ্রতি কাগজের দাম কমেছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এছাড়াও কাগজের মিলগুলো করোনাকালীন ব্যাংক ঋণ পরিশোধ ও নগদ টাকার সংগ্রহে কম লাভে কাগজ বিক্রি করেছে। এ কারণে সরকারের নির্ধারিত দামের (প্রাক্কলন) চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম দামে দরপত্র জমা দিয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছরের চেয়ে টনপ্রতি ২৮ হাজার টাকা কম দামে এছাড়াও এনসিটিবি সপ্তম শ্রেণির বই সিট মেশিনে ছাপানোর জন্য ১৩ হাজার মেট্রিক টন কাগজ ও বইয়ের মলাটের জন্য ১৩শ' আট পেপার কেনাতেও প্রায় ৩৯ কোটি টাকার সাশ্রয় হয়েছে।

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা তার দপ্তরে যায়যায়দিনকে বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রের নির্ধারিত দরের প্রায় ৩০ শতাংশ কমে জমা দেওয়ায় এবার ভালো অঙ্কের টাকা সাশ্রয় হবে। টাকার পরিমাণে কত তা এখনও হিসাব হয়নি। তিনি বলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম কমে যাওয়া এবং পেপারমিলগুলো কম লাভে কাগজ বিক্রি করায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে কাজ করতে রাজি হয়েছে।

 

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকে প্রায় ২৪ কোটি ৪১ লাখ বই ছাপানো হবে। এতে সরকারি ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। প্রাথমিকের বইয়ের চাহিদা এখনও না এলেও গত বছরের চাহিদা ধরে প্রায় ১০ কোটি ৫৪ লাখ বইয়ের দরপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলে বিনামূল্যের ৩৫ কোটি বই ছাপানোর জন্য সরকারের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১১০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেই টাকা থেকে প্রায় ৩০০ কোটি সাশ্রয় হচ্ছে।

 

জানা গেছে, প্রাথমিকের সাড়ে ১০ কোটি বই ছাপাতে ৯৮টি লটে টেন্ডার করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। ভারতের দুটি প্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির একজন সদস্য বলেন, সবক'টি লটে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কম দামে দরপত্র জমা দিয়েছে মুদ্রণকারীরা। এখানে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এছাড়াও

 

মাধ্যমিক স্তরে এনসিটিবি সিট মেশিনের জন্য কাগজ কিনে দেয়। এবার ১৩ হাজার মেট্রিক টন হোয়াট পেপার (৬০ ডিএসএম) কিনেছে ৬৫ হাজার টাকা দরে কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর এ কাগজ কেনা হয়েছিল ৯৩ হাজার ২২৪ টাকা করে। টনপ্রতি ২৮ হাজার টাকার বেশি সাশ্রয় হয়েছে। গত বছর প্রতি টন আর্টকার্ড ক্রয় করা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ২০০ টাকা করে। এ বছর প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকা দরে ক্রয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বছর ১৩শ' টন আট কার্ড কেনা হবে। গত বছর কেনা হয়েছিলো ২৪শ' টন। গত বছর ক্রয় করা ৩০০ টন কার্ড বাফারের গুদামে মজুদ থাকায় এ বছর আর্ট কার্ড কম কেনা হচ্ছে। এ বছর কাগজ ক্রয় করতে বাজেট থেকে ৩৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এতে শুধু মাধ্যমিক স্তরেই সাশ্রয় হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

 

মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিযোগিতা ও করোনাকালীন ব্যবসায় টিকে থাকতে তারা কম লাভে কাজ করতে প্রায় ৩০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দিয়েছি। তারা বলেন, এনসিটিবি বইয়ের দাম যখন ঠিক করে তখনও কাগজের দাম এত কমেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম কমে যাওয়ার খবর পেয়ে প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কম দামে হাঁকিয়েছি। এতে সরকারের কয়েকশ' কোটি টাকা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশীয় শিল্প রক্ষা পাবে।

 

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেন, গত বছর কাগজের প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করার সময়ে পার্লপের টনপ্রতি দর ছিল সাড়ে ৮০০ ডলার। এ বছর এ দর ৪৬০ ডলারে নেমে এসেছে। যে কারণে টনপ্রতি কাগজের দাম প্রায় ৩০ হাজারের বেশি কমে গেছে।

 

এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদস্য (অর্থ) মির্জা তারিক হিকমত বলেন, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির বই ৯৮টি লটে টেন্ডার দেওয়া হয়। প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দর দিয়েছে মুদ্রকররা। এতে গত বছরের চেয়ে অন্তত ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলেই বই ছাপার কার্যাদেশ দেওয়া হবে। প্রতি ফর্মা ২ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর এ শ্রেণির একটি বইয়ের গড় ছাপা খরচ ২৩ টাকা। এ বছর সে বই ছাপাতে খরচ হবে ১৮ টাকা ৩২ পয়সা। দুই বছর আগে বইপ্রতি খরচ হয়েছিল ৩৫ টাকা পর্যন্ত। একটি সিন্ডিকেট প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি দামে বই ছাপার কাজ নিত। এ বছর সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে ইজিপিতে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে।

 

এদিকে মুদ্রণকারীদের একাংশ দাবি করেছে, এত কম দামে কাজ দিলে বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। যেসব প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলনের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত কম দামে বই ছাপা দাম দিয়েছে তাদের প্রতি প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। তারা করোনাকালীন বিশেষ পরিস্থিতিকে সামনে রেখে শেষ সময়ে নিম্নমানের বই দিতে পারে। এজন্য এসব প্রতিষ্ঠানের পিজি (পারফরমেন্স সিকিউরিটি) বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, সরকারের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে মূল্যায়ন কমিটি এসব বিষয় দেখবে। তারা যদি মনে করে তবে পিজি বাড়াসহ আরও কঠোর কিছু শর্ত দিতে হতে পারে। মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না।

 

মান ঠিক রাখতে এনসিটিবি এবারও আরও শক্ত অবস্থানে থাকবে বলে জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, কম দামে কাজ নিলেও মানের ব্যাপারে কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে ছাড় দেওয়া হবে না। মান যাচাইয়ে মনিটরিং এজেন্সি ছাড়াও এনসিটিবির নিজস্ব টিম, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময় তৎপর থাকে। এবার সেটি আরও বাড়ানো হবে।

 

জানা গেছে, ২০০৯ সালে মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক কমে দরপত্র করে। ওই সময় বইয়ের মান ঠিক রাখতে একটি স্টিয়ারিং কমিটি করা হয়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এলিট ফোর্সর্ যাবকে রাখা হয়। ফোর্সটি বিভিন্ন সময় অভিযানও পরিচালনা করে। এবারও স্টিয়ারিং কমিটির দাবি উঠলেও মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত কিছু বলতে চাচ্ছেন না কর্মকর্তারা।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর