• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

প্ল্যানচেট করতেন কবি গুরু, তাঁর ডাকে সাড়া দিতেন সুকুমার, মধুসূদন!

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২২ এপ্রিল ২০২০  

প্ল্যান’চেট। একটি ঘরে টেবিলে’র বিভিন্ন প্রা’ন্তে কত’গুলি আলো-অন্ধকার’ময় মুখ। জ্বেলে রাখা মোম’বাতির আলোয় সেই মুখ’গুলিতে কাঁপা কাঁপা আলো’র রেখা। মৃত্যুর ওপা’রে রাখা জীবনের সন্ধা’নে উন্মুখ তারা। নিজে কখনও ট্রাই করুন বা না করুন, আপনি নিশ্চ’য়ই জানেন প্ল্যানচেট ব্যাপা’রটা কী। কেননা বিস্তর গল্প’গাছা ও সিনেমাতে প্ল্যান’চেটের দৃশ্য আমরা পেয়েছি।

 

 উন’বিংশ শতাব্দী থেকে বাংলার বুকে প্রেত’চর্চার এক ধারার সূচনা হয়। ১৮৮০ সালে প্যারী’চাঁদ মিত্র, শিশিরকুমার ঘোষ প্রমুখ স্থাপন করেন ‘ইউ’নাইটেড অ্যাসো’সিয়েশন অফ স্পিরিচুয়া’লিস্টস’। বছর পাঁচেকের মধ্যেই প্রয়াত হন তিনি। কিন্তু ততদিনে প্ল্যান’চেট বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছে।

 

সেই সম’য়ের তরুণ এক কবিও সমকালীন প্রেত’চর্চার এই ধারা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু সেই সময় নয়, তাঁর মধ্যে প্ল্যান’চেটের নেশা ঘন হয় অনেক পরে। তখন তিনি নোবেলজয়ী সত্তর ছুঁই ছুঁই এক বিশ্বকবি। প্রবল খ্যাতিমান। কিন্তু মনের গহীনে একের পর এক প্রিয় মানু’ষের মৃত্যুতে তৈরি হয়েছে দগ্ধ ক্ষতমুখ। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্ল্যানচেট করা শুরু করেন। উদ্দেশ্য চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া মানুষ’দের আবারও ক্ষণিকের জন্য পাওয়া। তাঁদের সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর নেওয়া।

 

 কৈশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে প্ল্যানচেটে ডাকার সাক্ষী ছিলেন তিনি। আসলে ঠাকুরবাড়িতে একটা প্রেত’লোকচর্চার আবহ ছিল। ১৩০১ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এক যন্ত্রের বিজ্ঞাপন। সেই যন্ত্র নাকি ভৌ’তিক! তার সাহায্যে নাকি যোগাযোগ করা যায় পর’পারের বাসি‌ন্দাদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’। ওই যন্ত্রের সাহা’য্যেই মাইকেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রবীন্দ্রনাথের।

 

 পরে কুড়ি-একুশ বছর বয়সেও প্ল্যানচেট করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই চক্রের অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ফলে তখনকার মতো যব’নিকা পড়ে গিয়েছিল কবির প্রেত’লোকচর্চায়।

 

আগেই বলেছি, তা ফের জেগে ওঠে ১৯২৯ সালে। বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের সুন্দরী যুবতী কন্যা কবি বুলা হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেই প্ল্যানচেটের ‘মিডিয়াম’। এই মিডিয়ামদের জীবন খুব আশ্চর্য ও বিষাদবিধুর। বলা হয়, এঁরা স্বল্পায়ু হন। বুলার জীবনেও তার অন্যথা হয়নি। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই প্রয়াত হয়েছিলেন তিনি।

 

 ১৯২৯ সালের শেষদিকে প্রায় দু’মাস নিয়মিত প্ল্যানচেটে বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাদা কাগজে পেন্সিল হাতে বসে থাকা বুলার শরীরে ভিড় করে আসত বিদেহী আত্মারা। রবীন্দ্রনাথ কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য একা থাকতেন না। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, নন্দলাল বসু থেকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর— কবির সঙ্গী ছিলেন অনেকেই।

 

 সত্যিই কি প্ল্যানচেটে আত্মা আসে? মৃত্যুর পরেও কি থাকে জীবন? রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘‘জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম। সেই এতটুকুর উপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলে না। তাছাড়া এত লোক দল বেঁধে মিছে কথা বলবে, এ আমি মনে করতে পারিনে।’’

 

বুলা সম্পর্কে কবির বক্তব্য, ‘‘ও কেন মিছে কথা বলবে? কী লাভ ওর ছলনা করে? এমন সব কথা বলছে যা ওর বিদ্যাবুদ্ধিতে সম্ভব নয়।’’

 

 কারা কারা এসেছেন কবির ডাকে? তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ আরও অনেকে। পরিবারের লোকরা ছাড়াও এসেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতচন্দ্র সেন। এবং এসেছেন সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথা সকলেই জানেন। সুকুমারের মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথ গান শুনিয়েছিলেন। প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়ে সুকুমার আবারও গান শুনতে চান কবিগুরুর কাছে। 

 

রবীন্দ্রনাথ

গেয়েছিলেন, ‘‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়।’’ সেই গান অবশ্য মাঝপথে থামাতে হয়। তিনি গানের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে সুকুমার জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার

পৃথিবীর নেশা আজও কাটেনি। তাই পরলোকের সুর আজও মনে লাগে না।’’ ‘‘কেমন আছ’’,

কবির এই প্রশ্নে সুকুমার জানান, ‘‘অন্য কথা

বলুন।’’

 

রবীন্দ্রনাথের এই প্রেতলোকচর্চা দীর্ঘদিন চলেনি। ১৯৩০ সালে তিনি ইউরোপে যান। আর ১৯৩১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান বুলা। ফলে বরাবরের মতো যবনিকা পড়ে যায় কবির প্রেতলোকচর্চায়। 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর