• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

বকশীগঞ্জ শত্রুমুক্ত দিবস, আজ থেকে শত্রুমুক্ত হয় জামালপুর

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০২০  

১৯৭১ এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দিয়ে তৎকালিন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমা আওয়ামীলীগের নের্তৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। পাক সেনাদের বিরোদ্ধে দেশ মাতৃকার টানে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে থাকে জামালপুরের টকবগে তরুণ যুবকরা। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সুত্রে জানাযায়, তৎকালিন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার অধীন দেওয়ানগঞ্জ থানার ধানুয়া কামালপুর এবং বকসিগঞ্জ ইউনিয়ন ছিল। বর্তমানে বকসিগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর একটি ইউনয়িন।

 

মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসূত্রে জানাগেছে,ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত কোচ বিহার জেলার মহেন্দ্রগঞ্জের সীমান্ত মাত্র ১ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত ছিল,বকসিগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর। তাই মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ। এ অঞ্চলে ১১নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার হিসাবে মেজর জিয়াউর রহমান দায়িত্ব পালন করেন। মেজর জিয়ার নামানুসারে মুক্তিযুদ্ধের (জেড ফোর্স) নামকরণ করে যাত্রা শুরু হয়। ১১নং সেক্টরের অধিনে নিয়মিত বাহিনী ছিল ৩ হাজার এবং গন বাহিনী ছিল ১৯ হাজার। মোট ২২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হয়ে ছিল ১১ নং সেক্টরটি। কিন্তু ধানুয়া কামালপুর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিঃমেন্ট পাক সেনাদের দূর্ভেদ্য সুরক্ষিত একটি শক্তিশালী ঘাটি ছিল। তাই মেজর জিয়া দায়িত্ব পালন কালে প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরা তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেন নি।

 

এ জন্য ৭১এর ১১আগষ্ট মুক্তিবাহিনীর হাইকমান্ডের নির্দ্দেশে মেজর জিয়াকে সরিয়ে তদস্থলে ১২আগষ্ট থেকে কর্ণেল আবু তাহের (বীর উত্তম)কে ১১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার পদে নিযুক্ত করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে প্রথম মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকারচর, পুরাকাশিয়া, ডালু, বাগমারা, শিববাড়ী , রংড়া, এবং মহেশখোলা এই এলাকাগুলোকে ৮টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন। জানা যায় কর্ণেল আবু তাহের এর নের্তৃত্বে এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরা পাক সেনাদের বিরোদ্ধে কমপক্ষে ১০বার সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। সর্বশেষ কর্ণেল আবু তাহের এর নেতৃর্ত্বে ১৪ নভেম্বর ধানুয়া কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পে আক্রমন চালান। ওইদিন যুদ্ধ চলাকালে পাকসেনাদের মর্টার সেলের আঘাতে কর্ণেল আবু তাহের এর বাম পা উডে যায়।

সে সময় মুক্তি বাহিনীর হাইকমান্ডের নির্দ্দেশে ১৫ নভেম্বর/৭১ থেকে উইংকমান্ডার এম হামিদুল­াহ খানকে তৃতীয় তম সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন দিক নির্দ্দেশনা প্রদান করেন। উইংকমান্ডার এম হামিদুল­াহ খান তিনি ১১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে ৩ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রে নিয়ে ধানুয়া কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্প একযোগে ঘিরে ফেলেন। উইংকমান্ডার হামিদুল­াহ খানের নির্দ্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (বীর প্রতীক) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু দু’জন জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝুকিঁ নিয়ে বীরদর্পে ধানুয়া কামালপুর পাকসেনা শত্রু ক্যাম্পে আত্মসমাপণ পত্র নিয়ে হাজির হন। চিঠি পেয়ে পাকসেনা কমান্ডার গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিক অগ্নিমূর্তি হয়ে তাদের দু’জনকে বেধড়ক পিটুনী ও অমানুষিক নির্যাতন করে দু’জনের শরীরে টাইম বোম লাগিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা জয়বাংলার শ্লোগান দিয়ে তুমুল লড়াই শুরু করে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত চলতে থাকে। সেদিন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বীরত্বপুর্ণ লড়াই করে তার দল নিয়ে পাকসেনা ক্যাম্পের মাত্র ৫শত গজ অদূরে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিলেন।

এমন সময় তার দলের ওয়্যারলেজ (বেতার যন্ত্রটি) হঠাৎ অকেজু হয়ে গেলে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের দলের সাথে মিত্র বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ভুলবসত পেছন থেকে তাদের উপর সেল নিক্ষেপ করে। সেলের আঘাতে মুহুর্তের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন সালাউদ্দিনসহ মুক্তিবাহিনীর মোট ৪শ ৯৭জন সে রাতে শহীদ হন। সারা রাতভর মুক্তি বাহিনীর তোপের মুখে টিকতে না পেরে অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্থানি গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিকসহ মোট ১শ ৬২ জন বেলুচ, পাঠান ও পাঞ্জাবী সৈন্যে ভোর রাতে আত্মসর্মপন করে। ফলে ৪ ডিসেম্বর সকালে ধানুয়া কামালপুর শত্রু মুক্ত হয় । এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির ও সঞ্জু উভয়ে লাল সবুজের বিজয়ী পতাকা সর্ব প্রথম ধানুয়া কামালপুরের মাটিতে উত্তোলন করেন। ধানুয়া কামালপুর বিজয়ের পর মুক্তিযুদ্ধাদের মনোবল ও আত্ম বিশ্বস বৃদ্ধিপায়।  ফলে ৫ডিসেম্বর তৎকালিন দেওয়ানগঞ্জ থানার বকসিগঞ্জ ইউনিয়ন (বর্তমানে বকসিগঞ্জ উপজেলা) মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয় দফা হানা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব পূর্ণ লড়াইয়ে পাকিস্থান শত্রু বাহিনী পরাজিত হলে দ্বিতীয় দফা ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে বকসিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের নাসির কোম্পানীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৫ডিসেম্বর বিকালে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দিনরাত সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে সারা রাত লড়াই শেষে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোর রাতে পাকিস্থানী শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করে তৃতীয় দফা দেওয়ানগঞ্জ সদর শত্রু মুক্ত করেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের নাসির কোম্পানীর কোম্পানী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন দেওয়ানগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিজয়ী পতাকা উত্তোলন করেন। সে সময় এলাকার মুক্তিগামী জনতা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে।

৭ডিসেম্বর ইসলামপুর মুক্তিযুদ্ধের জালাল কোম্পানী এবং বদি কোম্পানীর নের্তৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর বিকালে ইসলামপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওইদিন বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণপণে লড়াই করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব পুর্ণ লড়াইয়ে অবশেষে ৭ডিসেম্বর ভোর রাতে পাক-হানাদারদের চতুর্থ দফা পতন ঘটিয়ে চুড়ান্ত ভাবে শত্রু মুক্ত করেন ইসলামপুর। সে সময় হাজারও জনতা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন। ওইদিন সকালে ইসলামপুর থানা চত্ত¡রে জালাল কোম্পানীর কোম্পানী কমান্ডার শাহ মো.জালাল উদ্দিন প্রথম বিজয়ী পতাকা উত্তোলন করেন।

৮ডিসেম্বর মেলান্দহে ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে মিত্রবাহিনীর নির্দ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের আলম কোম্পানী,বদি কোমম্পানীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা মেলান্দহে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। রাত ভর সম্মুখ যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনী বিরোদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করতে থাকেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অবশেষে ৮ডিসেম্বর ভোর রাতে পাক-হানাদার বাহিনী পরাস্ত হলে মেলান্দহ পঞ্চম দফায় শত্রু মুক্ত হয়। সে সময় হাজারও ছাত্র-জনতা মুহু-মুহু জয়বাংলা শ্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে পুরো এলাকা। ওই দিন দুপুরে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আলম কোম্পানীর টু আই সি,পরবর্তি সেঙ্গাপাড়া যুদ্ধকালিন কোম্পানী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম সর্ব প্রথম বিজয়ী পতাকা উত্তোলন করেন।

১০ডিসেম্বর জামালপুর সদরে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক অধিনায়ক ইউসুফ আলীর নির্দ্দেশে ৮ডিসেম্বর সকালে জামালপুরের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। জামালপুর শহরের প্রইমারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পিটিআই) ছিল পাকসেনাদের চরম শক্তিশালী দূর্ভেদ্য ঘাঁটি। তাই মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক অধিনায়ক ইউসুফ আলীর নির্দ্দেশে তার কোম্পানীসহ নাসির কোম্পানী, বদি কোম্পানী, আলম কোম্পানী সহ মিত্র বাহিনীর সদস্যরা একত্রিত হয়ে জামালপুর সদরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রথমে মিত্র বাহিনীর বিগ্রেড কমান্ডার হরদেব সিং ক্লেয়ার এর নির্দ্দেশে মুক্তিযুদ্ধে মৃতঞ্জয়ী খেতাব প্রাপ্ত বীর প্রতীক মুন্সি জহুরুল হক নিজের জীবন বাজি রেখে কৃষকের বেশে আত্মসমাপন পত্র হাতে নিয়ে জামালপুর পিটিআই পাক সেনা ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে পাক সেনা ক্যাম্প কমান্ডার কর্ণেল সুলতান খানের কাছে চিঠি পৌছান। চিঠি পেয়ে পাকসেনা কমান্ডিং অফিসার সুলতান খান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। পরে আত্মসমাপণ অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের দূত বীর প্রতীক মুন্সি জহুরুল হককে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তার শরীরে টাইম বোমা বেধে সন্ধ্যা রাতে ব্র‏ম্মপুত্র নদের পাড়ে ফেলে দেয় পাক সেনারা। এ খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র বাহিনীর সদস্যরা সিংহের মত গর্জে উঠে শুরু করেন তুমুল আক্রমন। রাত দিন যুদ্ধ চলতে থাকে। ভারতীয় বোমারু বিমান এসে পিটিআই পাকসেনা ক্যাম্পে মুহুমুহু বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অবশেষে ১০ডিসেম্বর ওই দিন শুক্রবার পাক-হানাদার বাহিনীকে চুড়ান্ত ভাবে পরাজিত করে জামালপুর সদর সপ্তম দফা শত্রু মুক্ত করেন। জামালপুর মুক্তি যুদ্ধের হানাদার বাহিনীর ২৩৫ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৩৭৬ জন হানাদার সৈন্য আত্মসমর্পন করে। আর এই যুদ্ধে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর ১১জন বীরযোদ্ধা শহীদ হয়ে ছিলেন।

১২ডিসেম্বর জামালপুর সদর উপজেলার শত্রু মুক্ত করে বিকালে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা সরিষাবাড়ির অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সন্ধ্যা রাত থেকে লড়াই শুরু করে অবশেষে ১২ডিসেম্বর সকালে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে সরিষাবাড়িকে শত্রুমুক্ত হলে তৎকালিন জামালপুর মহকুমা বর্তমানে জামালপুর জেলা চুড়ান্ত ভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। ফলে স্বাধীন বাংলার বিজয়ী পতাকা পৎ পৎ করে উড়তে থাকে। উল্লেখ্য যে জামালপুর ৭টি উপজেলার মধ্যে শুধু মাত্র মাদারগঞ্জ উপজেলায় পাক হানাদারদের ঘাঁটি ছিল না বিধায় এ উপজেলায় শত্রুমুক্তের প্রয়োজন হয়নি। সর্বশেষ ঢাকা পাক-হানাদার মুক্ত হলে ১৬ডিসেম্বর মহান বিজয় অর্জিত হয়।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর