• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আত্মপ্রত্যয়ের বাংলাদেশ

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  

প্রতি বছর আগস্ট মাস আমাদের মাঝে ফিরে আসে শোকের আবহ নিয়ে। একই সঙ্গে আগস্ট আসে বঙ্গবন্ধুর কুখ্যাত ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আর শোককে শক্তিতে পরিণত করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দীপ্ত শপথ নিয়ে। ইতিহাস মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটি শব্দ একে অপরের পরিপূরক। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু নামটি একটি ইতিহাস। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ সাল মাত্র ৫৫ বছরের পার্থিব জীবনের সমগ্র সময়ই একটি মহাকাব্যের ইতিহাস। যদিও মহাকালের কাছে অর্ধশতাব্দী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র। তারপরও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব গাঙ্গেয় অববাহিকার পলল সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ সৃষ্টির মহাকাব্যের যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তা অনন্তকাল ধরে বহতা নদীর স্রোতের মতো বহমান থাকবে।

শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিবের প্রতিবাদ, নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের প্রবল বিকাশ ঘটেছিল। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা, খেলাধুলা, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কিংবা অন্যের সমস্যা ও বিপদে সবার আগে মানবিক দাবি নিয়ে এগিয়ে গেছেন। শিশুকাল পেরিয়ে কিশোর বয়সের শুরুতেই শেখ মুজিব সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন প্রতিবাদের মাধ্যমে দাবি আদায়ের নতুন 'ইতিহাস'। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসেন মহকুমা শহর গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষে তারা ডাকবাংলো ফিরছিলেন। শেখ মুজিব ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এমন সময় মুজিবের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের পথরোধ করে দাঁড়াল। প্রধান শিক্ষকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের পথ ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন; কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী চাও? শেখ মুজিব উত্তর দিলেন, আমাদের স্কুলের হোস্টেলের টিনের চালা ভাঙা, বৃষ্টির সময় পানি পড়ে, মেরামত করে দিতে হবে। এ জন্য তাৎক্ষণিকভাবে শেরেবাংলা স্কুল হোস্টেল মেরামতের জন্য ১২০০ টাকা বরাদ্দ করেন। কিশোর ছাত্রের প্রতিবাদী মানসিকতা, সৎ সাহস ও স্পষ্টবাদিতা দেখে মুগ্ধ হলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। পাশে দণ্ডায়মান গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে ফেললেন, এ ছেলেটি ভবিষ্যতে অনেক বড় রাজনীতিবিদ হবে। স্কুলজীবনে প্রতিবাদী নেতৃত্বের কারণে ১৯৩৯ সাল থেকেই শেখ মুজিবের কারাভোগ শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে মিশন স্কুল মাঠে ছাত্রদের জনসভা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি হয়। স্কুল মাঠ ছেড়ে মসজিদের সামনে জনসভা করেন তারা। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় শেখ মুজিবের কারাভোগ শুরু হয়। ১৯৪২ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্রাবস্থায় দৈনিক আজাদ পত্রিকা বন্ধের প্রতিবাদে তিনি ছাত্রদের নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেছেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন দাবি নিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৬ সালের মার্চে প্রাদেশিক নির্বাচনে উদীয়মান যুবক শেখ মুজিবকে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার নির্বাচন পরিচালনার সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কারণে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একান্ত আস্থাভাজনে পরিণত হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাক-ভারত বিভক্তির পর পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ রাজনীতিতে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়। এক গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; অন্য গ্রুপে ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব।

সময়ের বিবর্তনে এলো ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। জন্ম নিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৮-৫৩ পর্যন্ত শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলা-মহকুমা সফর করে কমিটি গঠন করে ছাত্রলীগকে নতুন ধারায় সংগঠিত করে অনন্য স্থান দেন। বলা যায়, '৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেশপ্রেমের নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব সেই আবেগ ও প্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটিয়ে পূর্ব বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। এরপর '৫৪ থেকে '৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১৮ বছরের জেল, জুলুম, নির্যাতন ও হুলিয়াকে আলিঙ্গন করে সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে এগিয়ে গেছেন সামনে। '৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, '৫৮-এর আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, '৬৬-এর ৬ দফা, '৬৯-এর গণআন্দোলন, '৭০-এর নির্বাচন, পরিশেষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ বিসর্জন এবং দুই লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রম আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বপ্নের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির জন্য শেখ মুজিবের ৫৫ বছরের জীবনের মধ্যে কারাভোগে কেটে গেছে ১২ বছর। গ্রেফতার হয়েছেন ১৮ বার। এমনকি ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন দু'বার।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির নাম উচ্চারিত হলেই বঙ্গবন্ধু নামটি চলে আসে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৪ দিনে একটি দেশকে সে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের আলোয় এক মহাকাব্য বলা যায়। জাতিসংঘের সদস্যপদসহ ওআইসি, আইএলও, ইউনেস্কো, ইউনিসেফের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যপদ অর্জন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মাত্র এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত সব ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, ভারতের সঙ্গে ছিটমহল চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ২৫ বছরমেয়াদি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন, যা ঐতিহাসিক 'মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি' নামে পরিচিত।

একটি রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল হচ্ছে সংবিধান। বঙ্গবন্ধু মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা করেন। দেশের অর্থনীতির মূল প্রাণশক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম বন্দর ও পাটশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেন। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশ বিমান চলাচল সংস্থা, সড়ক, রেল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো গঠন করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক রচনা করেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার এক বিরল দৃষ্টান্তের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে চীন ও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি আদায়। জাপান ঋণ সাহায্যের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করেন। এই সফরে যমুনা সেতু প্রকল্পে জাপানি সাহায্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদিত হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জাপান তার অঙ্গীকার থেকে সরে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও ড. কামাল হোসেনের রাষ্ট্রীয় সফরের মাধ্যমে জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মতো পুঁজিবাদী দেশগুলো বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে শুরু করে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ঋণ চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকে। সোভিয়েত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-এ দুই ব্লকের বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি সত্য; তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছিল। যার কিছু দৃষ্টান্ত, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্যপদ অনুমোদিত হলে চীন শুধু ভোটদানে বিরত থাকে। অথচ ১৯৭২ সাল থেকেই ভেটো প্রয়োগ করে আসছিল। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যায় চীনা রেড ক্রসের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে এবং বন্যার্তদের জন্য এক মিলিয়ন ডলার সাহায্য দান করে। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালের মে মাসে চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

সময় থেমে থাকে না, চলছে চলবেই। দেখতে দেখতেই চলে গেছে স্বাধীনতার ৪৮ বছর। অনেক বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তার সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়কে। মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কূটনৈতিক সাফল্য তথা সব ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় আজ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। ২০২১ সালে উদযাপিত হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই শোকের মাসে শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমাদের প্রতিজ্ঞা এবং প্রত্যাশা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশ পৌঁছে যাবে মধ্যম আয়ের বিশ্বদরবারে; ২০৪১ সালে উন্নীত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর