• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

যে কারণে জিহ্বা সংযত রাখা প্রয়োজন

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২ মার্চ ২০২০  

সমস্ত প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার জন্য, যিনি মানুষকে সুন্দর অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি নিয়ামত স্বরুপ মানব দেহে অনেক মূল্যবান অঙ্গ-প্রতঙ্গ সংযুক্ত করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পঞ্চেন্দ্রীয়।

আর পঞ্চেন্দ্রীয়ের মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জিহ্বা। কিন্তু জিহ্বা এমন এক মন্দ প্রবণ ইন্দ্রিয় যাকে দমন করা এক প্রকার জিহাদ। কেননা মানুষ তা ভালো-মন্দ উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। এর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম সেই ব্যক্তি যার জিহ্বা ও হাত হতে অপর মুসলিম নিরাপদে থাকে। 

 

উপরন্ত কুপ্রবৃত্তির সঙ্গে জিহ্বার সম্পর্ক বড়ই ঘনিষ্ঠ। অশ্লীন কথাবার্তা বলা ও মানুষকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়া হচ্ছে এই অঙ্গের প্রধান কাজ। এজন্য বলা হয়ে থাকে, লৌহ তরবারীর আঘাত ও তীর বিঁধা জখমের উপশম আছে, কিন্তু বাকতরবারীর ও কথার তীরের আঘাতের কোনো উপশম নেই। 

 

তরবারীর ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজ আছে, কিন্তু জিহ্বার কোনো ব্যান্ডেজ নেই। কেননা তরবারী আঘাত করে বাহ্যিক অঙ্গে আর জিহ্বা আঘাত করে অন্তরের মর্মমূলে। আর সে জন্যই ‘হাড় ভাঙ্গলে জোড়া লাগে, কিন্তু মন ভাঙ্গলে জোড়া লাগে না। সুতরাং এমন শক্রকে দমন করা জিহাদ নয় তো কি?

 

বাক সংযমের গুরুত্ব: 

 

বাক সংযম করা খুব সহজ নয়। কেননা এর কারণে কাল কেয়ামতের মাঠে অনেক মানুষ জাহান্নামী হবে তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যার প্রতি খাস রহমত করেছেন, তার জন্য খুবই সহজ। উপরন্ত সে পরকালে সফলকাম হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআন কারিমে অসংখ্য জায়গায় মুমিনদেরকে বাকসংযমের নির্দেশ দান করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,

 

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ

 

الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ

 

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

 

অর্থাৎ: অবশ্যই মুমিনরা সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনম্র,যারা অসার ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকে। (সূরা: আল মু’মিনুন, আয়াত: ১-৩)।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন,

 

وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا

 

‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং অসার ক্রিয়া-কথার সম্মুখীন হলে ভদ্রতার সঙ্গে পরিহার করে অতিক্রম করে। (সূরা: ফুরকার,  আয়াত: ৭২)।

 

مَا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ

 

মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবৃদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী একজন ফেরেশতা তাদের নিকটে রয়েছে। (সূরা: ক্বাফ, আয়াত: ১৮)।

 

তিনি আরো বলেন,

 

وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً

 

যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই সে বিষয়ে অনুমান করে কথা বলো না। কেননা কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় ওদের প্রত্যেকের বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা: বানী ইসরাঈল, আয়াত: ৩৬)।

 

অন্যত্রে তিনি বলেন,

 

يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

 

সে দিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে। (সূরা: নূর, আয়াত: ২৪)।

 

জিহ্বা সংযত রাখার জন্য নবী (সা.) এর নির্দেশ: রাসূলুল্লাহ(সা.) এ সম্পর্কে বলেন,

 

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে নয়তো বা চুপ থাকে।’ (বুখারী হা: ৬০১৮)।

 

সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ (আ.) বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বললাম হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! সব চেয়ে বেশি কোন জিনিসকে আমার ওপর আশংকা করেন তিনি স্বীয় জিহ্বাকে ধারন করে বললেন, ‘এই টাকে।’(তিরমিযী)।

 

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

 

‘বান্দার ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবে না, যতক্ষণ না তার অন্তর সঠিক হবে। আর তার অন্তর সঠিক হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার জিহ্বা সঠিক না হবে ‘ (মুসনাদে আহমাদ)।

 

আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি আদম সন্তানের অধিকাংশ পাপ তার জিহ্বা দ্বারাই সংঘটিত হয়। (সিলসিলা সহীহ)।

 

জিহ্বা সংযত রাখার ফজিলত:

 

জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন: মুসলমানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? ‘তিনি (সা.) বলেন যে ব্যক্তির জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদে থাকে।’ (মুসলিম)।

 

রাসূল (সা.) আরো বলেন,

 

‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও গুপ্তাঙ্গের জামিন হবে আমি তার জন্য বেহেশতের জামিন হবো।’ (বুখারী হা: ৬৪৭৪)।

 

জিহ্বা হেফাজত না করার ভয়াবহ পরিণতি:

 

রাসূল (সা.) বলেন, বান্দা নির্বিচারে এমনও কথা বলে ফেলে যার দরুন সে পূর্ব ও পশ্চিমের সমপরিমাণ স্থান জাহান্নামে নিপতিত হয়।’(বুখারী ও মুসলিম)।

 

তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ এমনও কথা বলে যাতে সে কোনো ক্ষতি আছে বলে মনেই করে না। অথচ তার দরুন সে ৭০ বছরের পথ জাহান্নামে অধঃপতিত হয়। (সহিহহুল জামে)।

 

প্রত্যেক প্রভাতে মানব দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে সতর্ক করে: হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক প্রভাতে আদম সন্তানের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, যেহেতু আমরা তোমারই অনুগামী। সুতরাং তুমি সোজা হলে আমরা সোজা হই, নচেৎ তুমি টেড়া হলে আমরাও টেড়া হয়ে যাই।’ (সহিহুল জামে)।

 

জিহ্বার হেফাজত সম্পর্কে সালাফদের মূল্যবান উক্তি:

 

ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, তার কসম যিনি ব্যতীত সত্য কোনো ইলাহ নেই। জিহ্বা ছাড়া ভূপৃষ্ঠে আর কোনো বস্তু নেই যাকে দীর্ঘ কারাবদ্ধ (সংযত) রাখার প্রয়োজন। (মুসান্নাফ ইবনে  আবী শাইবা)।

 

ইবনে উমর (রা.) বলেন, মুসলিমের জন্য সবচেয়ে সংশোধনযোগ্য অঙ্গ হলো তার জিহ্বা। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা)।

 

ইমাম শায়েফী (রা.) রাবীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, হে রাবী! অনর্থক কথা বলো না। যেহেতু তোমার বলে ফেলা কথা তোমাকে এক দিন পাকড়াও করবে। সুতরাং জিহ্বাকে সংযত রাখো।

 

ওমর বিন আব্দুল আযীয (রা.) বলেন, হৃদয় হলো রহস্যের সিন্দুক, ওষ্ঠাধার হলো তার তালা, আর জিহ্বা হলো তার চাবি। অতএব, প্রত্যেকের উচিত, নিজের গুপ্ত রহস্যের (গুপ্ত ভাণ্ডারের) চাবি হেফাজত রাখা, কেন না মানুষের প্রকৃত পরিচয় গোপন থাকে তার জিহ্বায়।

 

ইবনুল কাইয়্যুক (রা.) বলেন: মানুষের জন্য মদ্য পান, চুরি যিনা, জুলুম, হারাম ভক্ষণ করা ও অবৈধ দৃষ্টিপাতসহ আরো অন্যান্য বিষয়ে নিজেকে হেফাজত করা খুবই সহজ। কিন্তু জিহ্বাকে সংযত করা তার জন্য অনেক কঠিন ব্যাপার। আপনি অনেক লোককে দেখতে পাবেন যে, তারা অশ্লীনতা ও জুলুম থেকে বেঁচে থাকে কিন্তু তাদের জি্বো সর্বদা মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদের মান-সম্মান নষ্ট করতেও  পরোয়া করে না।’

 

জিহ্বা সংযত রাখার পদ্ধতি:

 

(ক) মুমিন যখনই কোনো কথা বলার ইচ্ছা করবে তখন তার দ্বারা দ্বীনি উপকার ও কল্যাণ আশা করবে।

 

(খ) মুমিন যখনই কোনো বাক্য উচ্চারণের ইচ্ছা করবে তখন তার চিন্তা করা উচিত যে, তার উক্ত কথাতে কোনো উপকার আছে কি-না। থাকলে বলবে নয়তো বা বলবে না। কেননা জ্ঞানীর জিহ্বা থাকে তার হৃদয়ের পশ্চাতে। তাই যখন সে কিছু বলার ইচ্ছা করে, তখন সে হৃদয়ের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করে। যদি তা বলা উপকারী হয় তাহলে বলে, নচেৎ বলে না। পক্ষান্তরে মুর্খের হৃদয় থাকে জিহ্বাগ্রে, সে বলার পূর্বে হৃদয় ভাবে না। ফলে মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে। অতঃপর বলার পর লজ্জিত হয়ে আফসোস করে।

 

জিহবা সংযত রাখার উপকারিতা:

 

(ক) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা অর্জিত হয়। (খ) জাহান্নাম থেকে নিঃস্কৃতি লাভ হয়। (গ) জান্নাতের সুসংবাদ অর্জিত হয়। (ঘ) গুনাহ কম সংঘটিত হয়। (ঙ) চরিত্র ও ব্যবহার সুন্দর হয। (চ) তিরস্কার, লাঞ্চনা ও অশান্তি থেকে নিঃস্কৃতি লাভ হয়। (ছ) সর্বদা অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়। (জ) ইবাদতের সওয়াব অর্জিত হয়, কেন না নীরবতা বিনা কষ্টের এক ইবাদত। (ঝ) বাক তরবারীর  আক্রমন থেকে নিরাপত্তা লাভ হয়।

 

জিহ্বার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ভয়ানক আপদ:

 

১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে গালি দেয়া।
২. গাইরুল্লাকে আহ্বান করা।
৩. আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা।
৪. গণককে ভাগ্য-ভবিষ্যৎ জিজ্ঞাসা করা।
৫. পিতা-মাতাকে গালি দেয়া।
৬. মিথ্যা বলা ও গীবত করা।
৭. মানুষকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা ও মন্দ সম্বোধনে ডাকা।
৮. অশ্লীন গান গাওয়া।
৯. তাগূত্ব শাসকের নিকট বিচার ফায়সালা প্রার্থনা করা।
১০. কারো মুখোমুখি প্রশংসা করা।
১১. শিরকি কথা-বার্তা বলা।
১২. মুসলিমকে গালি দেয়া।
১৩. মসজিতে সাংসারিক গল্ট-গুজব করা।
১৪. পাপ রহস্য প্রকাশ করা।
১৫. বংশ নিয়ে গর্ব করা
১৬. কাফির বলার মূলনীতি না জেনে মুসলিমকে কাফির বলা।
১৭. খারেজী বলার মূলনীতি না জেনে মুসলিমকে খারেজী হিসেবে ফতোয়া দেয়া।
১৮. বিনা ইলমে ফতোয়া দেয়া।
১৯. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর মিথ্যা বলা।
২০. নেতৃত্বে লাভের পর অহংকারী কথা-বার্তা বলা।

 

পরিশেষে : আমাদের  সবার ওপর ওয়াজিব জিহ্বাকে সংযত রাখা, যাতে করে আমরা কাল কেয়ামতের মাঠে সফলতা অর্জন করতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর