• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

শিক্ষায়-সেবায় অনন্য মির্জাপুরের কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

প্রসবকালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় কুমুদিনী দেবীর। দারিদ্র্যের কারণে মৃত্যুকালে জোটেনি কোনো ওষুধ, ‘অস্পৃশ্যতা’র অছিলায় মেলেনি সেবাযত্নও। মায়ের এই মৃত্যুদৃশ্য নীরবে দেখেছে সাত বছরের বালক রণদাপ্রসাদ। শৈশবের এই দুঃসহ স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই তো বড় হয়ে সামর্থ্য অর্জনের পর নিজ গ্রাম মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেন হাসপাতাল। নাম দেন ‘কুমুদিনী হাসপাতাল’।

১৯৪৪ সালে উদ্বোধনের সময় ২০ শয্যা ছিল কুমুদিনী হাসপাতালে। অল্প দিনেই ৭৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতালে পরিণত হয় এটি। দীর্ঘ ৭৭ বছর ধরে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই হাসপাতাল।

শুধু হাসপাতাল নয়, শিক্ষা বিস্তারের জন্য রণদাপ্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী কলেজ, দেবেন্দ্র কলেজসহ আরও কত প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরাধিকারীরা কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, রণদাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। 

এসব প্রতিষ্ঠান আজও সেবা দিচ্ছে, শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। রণদাপ্রসাদ সাহার এই কীর্তি আজ টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যের অংশ।

রণদাপ্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর। বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা। তাঁদের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। মাকে হারানোর পর তিনি কৈশোরে বাড়ি পালিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে কুলিগিরি, পত্রিকার হকারি, ফেরিওয়ালা, রিকশা চালানোর মতো কাজ করে টিকে থাকেন। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে। যুদ্ধ থেকে ফিরে কিছুদিন রেলওয়েতেও চাকরি করেন। একপর্যায়ে সব ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প দিনেই সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তবে ব্যবসায় অর্জিত অর্থ তিনি নিজের আয়েশি জীবনের জন্য ব্যয় করেননি। সবকিছুই করেন মানুষের কল্যাণে।

১৯৩৮ সালে হাসপাতালের কাজ শুরুর সময় রণদাপ্রসাদ সাহার স্ত্রী মেয়েদের জন্য একটি আবাসিক স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশে প্রথম এই আবাসিক স্কুলই হচ্ছে ভারতেশ্বরী হোমস।

১৯৩৮ সালে মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারির ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯৪৪ সালের ২৭ জুলাই বাংলার তৎকালীন গর্ভনর লর্ড আর কেসি ২০ শয্যা কুমুদিনী হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। সে সময়েই রণদাপ্রসাদ সাহা আমেরিকা, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসক নিয়ে আসেন এ হাসপাতালে। 

ফলে শুধু এই অঞ্চল নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগী ছুটে আসতেন এ হাসপাতালে। অনেক জটিল অপারেশনসহ নানা রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে এ হাসপাতালে।

কুমুদিনী হাসপাতাল শুধু চিকিৎসাসেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়নি; তাই ২০০১ সালের ৪ জুন রণদাপ্রসাদ সাহার নাতি রাজীব প্রসাদ সাহার হাত ধরে হাসপাতাল ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু হয় ‘কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ’। 

শুধু চিকিৎসাসেবা নয়, ভালো মানবিক গুণসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরি করার উদ্দেশ্যে এর যাত্রা শুরু হয়। তাই অল্প সময়েই চারদিকে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরে থেকেও শিক্ষার্থীরা আসছে পড়াশোনা করতে। এখানে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে।

ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা প্রদর্শনীর সুনাম সারা দেশে। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে দেশে–বিদেশে প্রশংসা অর্জন করেছে।ছবি: প্রথম আলো

১৯৭৩ সালে এখানে চালু করা হয়েছিল নার্সিং ইনস্টিটিউট। শুরুতে নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্স করানো হতো। ২০০৭ সালে চালু করা হয়েছে বিএসসি নার্সিং কোর্স। বর্তমানে নার্সিং বিষয়ে এমএসসি কোর্স চালুর বিষয়টিও অনুমোদন লাভ করেছে। 

কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে ‘কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড ক্যানসার রিসার্স’ স্থাপনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন।

১৯৩৮ সালে হাসপাতালের কাজ শুরুর সময় রণদাপ্রসাদ সাহার স্ত্রী মেয়েদের জন্য একটি আবাসিক স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশে প্রথম এই আবাসিক স্কুলই হচ্ছে ভারতেশ্বরী হোমস। স্কুলের জন্য পাকা দালান তৈরি শেষে ১৯৪৫ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। শুরু থেকেই নিরাপদ আবাসিক পরিবেশে থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক চর্চা, শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা প্রদর্শনীর সুনাম রয়েছে সারা দেশে। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এই শিক্ষার্থীদের ড্রিল (শরীরচর্চা) দেশে–বিদেশে প্রশংসা অর্জন করেছে।বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে স্কুল ও কলেজ শাখায় সাড়ে সাত শ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

ভারতেশ্বরী হোমস ২০২০ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করে।

নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য রণদাপ্রসাদ সাহা ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইল শহরে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী কলেজ। ১৪ দশমিক ১৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ বৃহত্তর ময়মনসিংহে মেয়েদের প্রথম কলেজ। শুধু উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি দিয়ে শুরু হলেও কয়েক বছরের মধ্যে স্নাতক শ্রেণি চালু করা হয়। শুরু থেকেই নিরাপদ পরিবেশে মেয়েদের হোস্টেলে থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মেয়েরা এই কলেজে পড়তে আসতেন। 

কলেজটি ১৯৭৯ সালে জাতীয়করণ করা হয়। প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী বর্তমানে এখানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ছাড়াও ১৬টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান এবং ৮টি বিষয়ে স্নাতকোত্তরে লেখাপড়া করছেন।

শুরু থেকেই নিরাপদ আবাসিক পরিবেশে থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চা, শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে ভারতেশ্বরী হোমসে।

শুধু টাঙ্গাইলে নয়, রণদাপ্রসাদ সাহা ১৯৪৪ সালে মানিকগঞ্জে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ সাহার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দেবেন্দ্র কলেজ’। সে সময় মানিকগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় কোনো কলেজ ছিল না। 

দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানিকগঞ্জে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের দ্বার উম্মোচন করেন রণদাপ্রসাদ সাহা। দেবেন্দ্র কলেজ এখনো জেলার সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কুমুদিনী ট্রাস্টের আওতায় নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রণদাপ্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়।

অন্যদের স্থাপন করা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও রণদাপ্রসাদ সাহার অবদান স্বীকৃত। টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজ, মির্জাপুর এস কে পাইলট হাইস্কুল, কাগমারী মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, বরিশাল আলতাব মেমোরিয়াল স্কুল, ভূঞাপুর ইবরাহিম খাঁ কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রণদাপ্রসাদ সাহার আর্থিক সহায়তা রয়েছে। সমাজকল্যাণমূলক কাজ ও দানের কারণে এলাকার মানুষ তাঁর নামের আগে ‘দানবীর’ যোগ করে থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং এদেশীয় দোসররা রণদা প্রসাদ সাহা এবং তাঁর ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। আর তাঁরা ফিরে আসেননি।

১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ রণদাপ্রসাদ সাহা তাঁর সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কল্যাণধর্মী কাজের স্বার্থে একটি ট্রাস্টভুক্ত করেন। ট্রাস্টের নামকরণ করেন ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন রণদাপ্রসাদ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং এদেশীয় দোসররা তাঁকে এবং তাঁর ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। আর তাঁরা ফিরে আসেননি।

দেশ স্বাধীনের পর রণদাপ্রসাদ সাহার মেয়ে জয়াপতি ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন। তিনি অবসর নেওয়ার পর রণদাপ্রসাদ সাহার নাতি রাজীব প্রসাদ সাহা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। রণদাপ্রসাদ সাহা নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে আজও চলছে সেবা ও শিক্ষার আলো ছড়ানোর কাজ।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর