• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

সূর্যোদয়ের সময় যে দোয়া পড়তে হয় ও তার মর্মার্থ

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

আমাদের প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যোদয়ের সময় নিম্মোক্ত দোয়াটি পড়তেন।

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَقَالَنَا يَوْمَنَا هَذَا وَلَمْ يُهْلِكْنَا بِذُنُوبِنَا 

উচ্চারণ: আলহামদুলিল্লাহিল্লাযি আকালানা হাযা ইয়াওমানা, ওয়ালাম ইউহলিকনা বিজুনুবিনা।

 

অর্থ: সব প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি আমাদের জন্য আমাদের এই দিনকে আলোকিত করেছে এবং যিনি আমাদেরকে আমাদের গুনাহের কারণে ধ্বংস করে দেননি (মুসলিম)।

 

এই দোয়ার মধ্যে দু’টি বাক্য রয়েছে। উভয় বাক্যে রয়েছে মর্ম ও তাৎপর্যের বিস্তৃত এক জগত। বাক্য দু’টির মাঝে সুপ্ত রয়েছে, আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব, প্রজ্ঞা ও নৈপুন্যের এক বিশাল জগত। মূল আরবি দোয়া মুখস্থ না থাকলে মাতৃভাষায় এই প্রার্থনা করবে, আয় আল্লাহ, আপনার শোকর, আপনি এই দিনটি আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই শোকর আদায়ের কারণ এই যে, আমরা যখন রাত্রি বেলা ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন আমাদের জানা ছিল না, ভোর বেলা আমরা জাগ্রত হতে পারব কি না। জীবনের এই সময়টুকু কি ঘুমের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে না তো? বহু মানুষ রাতে সুস্থ স্বাভাবিক ঘুমিয়েছে। কিন্তু ঘুম থেকে আর জেগে উঠেনি। ঘুমের মধ্যেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে।

 

ঘুমের মধ্যে প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যায়: আল্লাহ তায়ালা মানুষের মৃত্যুর সময় প্রাণ হরণ করেন। মৃত্যুর সময় মানুষের দেহ আগের মতোই দেখা যায়। তবে দেহের ভেতর থাকা রুহ আল্লাহ তায়ালা কবজ করে নেন। আর যার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে না আসে, আল্লাহ তায়ালা তাদের রুহও প্রতিদিন ঘুমের মধ্যে কবজ করেন। এ কারণেই ঘুমের মধ্যে আমাদের কোনো অনুভূতি থাকে না। দুনিয়ায় কী হচ্ছে না হচ্ছে তার কোনো খবরই থাকে না। এর কারণ হলো, রুহ তখন আংশিক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর যার তাকদিরে মৃত্যু লেখা থাকে, আল্লাহ তায়ালা তার রুহ ফিরিয়ে দেন না। ফলে ঘুমের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। আর এখনও যার মৃত্যু লেখা হয়নি, তার রুহ আল্লাহ তায়ালা ফিরিয়ে দেন। ফলে সে জেগে ওঠে। স্বাভাবিক জীব ফিরে পায়।

 

ঘুমানোর আগের দোয়া: তাই নবী করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের সাধারণ অভ্যেস ছিল, ঘুমানোর পূর্বে কোরআন শরিফের উল্লেখিত আয়াতের মর্ম ও তাৎপর্যের প্রতি ধ্যান করতেন। আয় আমার পরওয়ার দিগার, আপনার নামে আমি আমার পার্শ্ব বিছানায় রেখেছি। এবং আপনার নামেই উঠব। আপনি যদি আমার প্রাণ রেখে দেন, ঘুমের মধ্যেই যদি জান কবজ করেন তাহলে তাকে ক্ষমা করবেন। আর যদি প্রাণ ছেড়ে দেন আমাকে যদি বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে আপনি আমার এই প্রাণ হেফাজত করুন। যেভাবে আপনি আপনার নেক্কার বান্দাদের প্রাণ হেফাজত করেন। (বোখারি, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ)।

 

অর্থাৎ: আমার প্রাণ ফিরে আসা তখনোই স্বার্থক হবে যখন খোদ আপনি একে হেফাজত করবেন। গুনাহ ও বদআমল থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। যখন আপনি একে জাহান্নামের শিকার বানাবেন না এবং শয়তানের জালে ফাসাবেন না তখনোই এই জীবন কামিয়াব প্রমাণিত হবে। নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিখানো দোয়াসমূহের মতো সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ আর কোনো দোয়াই হতে পারে না।

 

এই দিন আল্লাহ তায়ালার অনন্য নেয়ামত: তারপর যখন রাত অতিবাহিত হলো, সকাল হওয়ার মধ্যদিয়ে যখন দিন শুরু হলো এবং সূর্য উদিত হলো তখন জানা গেল, আলহামদুলিল্লাহ রাতটি আমার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসেনি। আল্লাহ তায়ালা আমাকে জীবনে আরো একটি দিন দান করলেন। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম সূর্য ওঠার সময় এই দোয়া করতেন, সমস্ত শোকর ও প্রশংসা আপনার জন্য, যিনি আমাকে আজকের দিনটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আজ এই জুমার দিন আমরা সকলে এখানে একত্র হয়েছি। 

 

আমাদের কারুর কি জানা আছে যে, আগামী দিনের সাক্ষাত আমি পাব? তাই দিনের শুরুতেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিকে আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন যে, আজকের এই দিনটি আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। জিন্দাহ থাকার জন্য এই দিনটি না পেলে কিছুই করার ছিল না আমাদের। তাই প্রথমেই এই অনন্য সাধারণ নেয়ামতের জন্য আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করা উচিত। তারপর এই দিনটিকে যেন গাফলত ও আলস্যের কারণে একটি মুহূর্তর অপচয় না হয়।

 

যদি এ দিনটি না পেতে: যদি তোমরা এই দিনটি না পেতে, যদি ঘুমের মধ্যেই তোমাদের মৃত্যু এসে যেত এবং এই অবস্থায়ই আল্লাহ তায়ালার সামনে হাজির করা হত এবং আমল খারাপ হওয়ার কারণে যদি আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন তাহলে এই আফসোস করা ছাড়া কিছুই করা থাকত না। ইশ! যদি একটি মাত্র দিন পেতাম তাহলে সব গুনাহ থেকে তাওবা করে নিতাম। বিগত জীবনের গুনাহ খাতা মাফ করিয়ে নিতাম এবং হিসাব নিকাশ ঠিক করে নিতে পারতাম। আল্লাহ তায়ালা এ জাতীয় আফসোস ছাড়াই এই দিনটি তোমাদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং এই দিনটি কাজে লাগাও এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে আক্ষেপের কারণ না হয় এমন কাজ কর। কেননা আজকের দিনটি তোমরা পেয়েছ ঠিক কিন্তু আগামী কালও যে পাবে এর আদৌ কি নিশ্চয়তা আছে? অতএব, তোমরা আজকের দিনটি সঠিকভাবে কাজে লাগাও।

 

সময় চলে যাওয়ার পর সুযোগ পাবে না: কোরআনুল করিমে এসেছে, আখেরাতে যখন আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে লোকজনকে উপস্থিত করা হবে তখন এক ব্যক্তি বলবে, আয় আল্লাহ, আপনি আমাকে মৃত্যু দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে যদি আর কিছুদিন সুযোগ দিতেন এবং স্বল্প সময়ের জন্য যদি আমাকে পুনরায় দুনিয়ায় পাঠাতেন তাহলে আপনি দেখতেন আমি কতো ভালো হয়ে যাই। (সূরা: মুনাফিকুন, আয়াত: ১০)। 

প্রতি উত্তরে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

 

ولن يو خر الله لفسا اذا جاء اجلها

 

যখন কারুর মৃত্যুর সময় এসে পড়বে তখন মৃত্যু তার জন্য অবধারিত হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা করুর মৃত্যু বিলম্ব করেন না। এক মিনিট এদিক সেদিক হয় না। এ কারণে উল্লেখিত দোয়ার মাধ্যমে নবী করিম সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম এই দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে এই সকরুন প্রার্থনা করার পূর্বে কোনো রূপ কাকুতি মিনতি ছাড়াই এই দিনটি তিনি তোমাদেরকে দান করেছে। এই দিনটির ব্যাপারে তোমরা নিঃসন্দেহে এ কথা ভাবতে পার যে, আমরা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।

 

মনে কর এটা তোমার জীবনের শেষ দিন: একটু চিন্তা করুন, এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে। আজ রায় কার্যকর করার নির্ধারিত দিন। ফাসির মঞ্চ তৈয়ার করা হয়েছে। সেই ব্যক্তিকে ফাঁসির কাষ্ঠে হাজির করা হয়েছে। গলায় রশি লাগানো হয়েছে। এখন শুধু বাকি জ্লোদের রশি টান দেয়া। এতটুকুতে তার জীবন বাতি নিবে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে যদি কোনো বিচারপতি ফাঁসি কার্যকর করার তারিখ একদিন পিছিয়ে দেন। তাহলে বলুন সেই ব্যক্তি কী পরিমান খুশি হবে। অন্যদিকে সে তার জীবনের একটি মাত্র দিন কীভাবে কাটাবে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিকেই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন যে, তোমরা যে একটি নতুন দিন পেলে, এটি এমনই এক দিন, ফাঁসির আসামির রায় কার্যকর করার দিন যেমন আল্লাহ তায়ালা একটি দিন উপহার দিলেন। ফাঁসির আসামি যেভাবে কাটাবে তার জীবনের সেই আখেরী দিন, আজকের দিনটিও আমাদের ঠিক সেইভাবে কাটানো উচিত।

 

আবদুর রহমান ইবনে আবু নুয়াম রহ. এর ঘটনা: আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত বান্দাগণ জীবনের প্রতিটি দিন এ নিয়মে কাটিয়ে দেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু নুয়াম রহ. ছিলেন বিশিষ্ট তাবয়ে তাবেয়ীদের একজন। তার জীবনের একটি ঘটনা শোনাব। সেই সময়কার এক ব্যক্তি সমকালীন বুজুর্গানে দ্বীনের সঙ্গে সাক্ষাত মোলাকাত করার সংকল্প করলেন এবং সবাইকে একটি প্রশ্ন করবেন বলে ঠিক রলেন। প্রশ্ন ছিল, আপনি যে কোনো উপায়ে জানতে পারলেন আগামীকাল বারোটায় আপনার ইন্তেকাল হবে। আপনার হাতে আছে আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। এখন চব্বিশ ঘণ্টা আপনি কী আমল করবেন? লোকটি ভেবে ছিলেন, প্রত্যেক বুজুর্গের আমল ও অবস্থা হবে আলাদা। তাই প্রত্যেক বুজুর্গ অন্তিম সময়ের প্রিয় আমলের কথাই তারা বলবেন। সবচেয়ে স্বার্থক ও কার্যকরি আমলের কথাই বলবেন। ফলে তিনি বহু বুজুর্গের দরবারে গেলে, তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন পছন্দের কথা বলেছেন। সেমতে তিনি হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু নুয়াম রহ. এর নিকট গেলেন। এবং প্রশ্ন করলেন, আপনি আপনার জীবনের অন্তিম চব্বিশ ঘণ্টা কীভাবে কাটাবেন? তিনি জবাবে বললেন, আমি সেই দিন তাই করব আজ যা করছি। কারণ, আমি আমার জীবনের প্রতিটি দিনকেই শেষ দিন মনে করি। সুতরাং প্রতিদিন আমি যেভাবে আমল করি তার ওপর কোনো কিছু বাড়াতে পারব না। মোটকথা, এই দোয়ার প্রথম বাক্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই প্রার্থনাই শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালার শোকর। তিনি আমাকে আজকের দিনটি ফিরিয়ে দিয়েছেন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর