• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

সৌদি ভিসা কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০২৩  

হঠাৎ করে সৌদি দূতাবাস নিয়ম করে যে, একটি রিক্রুটিং এজেন্সি সপ্তাহে ২০টির বেশি ভিসা আবেদন জমা দিতে পারবে না। একটি এজেন্সি সপ্তাহে মাত্র একবার ভিসা আবেদন করতে পারে। সৌদি আরবে কর্মীর চাহিদা বেশি। চাহিদার কারণে অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি সপ্তাহে কয়েকশ পাসপোর্ট নিয়ে কাজ করে। ভিসা পেতে এই এজেন্সিগুলো সমস্যায় পড়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মীদের ভিসা পাইয়ে দিতে সৌদি দূতাবাসের কর্মীরা ঘুষ নেওয়া শুরু করে।


তাদের ডলারে ঘুষ দিয়ে ভিসা ছাড় করাতে হয়েছে। ঢাকায় সৌদি আরব দূতাবাসের ভিসা কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৮ বাংলাদেশীসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি সরকার। সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশী গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় যোগাযোগ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভিসায় ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আরও যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি জড়িত তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
সৌদিগামী কর্মীদের পাসপোর্ট গ্রহণ ও ভিসা স্ট্যাম্পিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় বেসরকারি ফার্ম ‘শাপলা সেন্টার’কে। শাপলা সেন্টারকে এই দায়িত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা)। বায়রার আন্দোলনের কারণে শেষমেশ সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সৌদি দূতাবাস। সৌদি


দূতাবাসের এসব কাজে যেসব বাংলাদেশী সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্ররোচিত করেছে তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হচ্ছে। বিশেষ করে যে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক এই ধরনের অভিযোগে আটক হয়েছে তার বিরুদ্ধে খোঁজ-খবর নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা।
সৌদি আরব সরকার ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসের ভিসা কেলেঙ্কারির ঘটনায় আট বাংলাদেশীসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আট বাংলাদেশী ছাড়াও রয়েছে ঢাকায় সৌদি আরব দূতাবাসের সাবেক দুই কর্মকর্তাসহ পাঁচজন। এ ছাড়াও এই ঘটনায় আরও তিনজনকে বরখাস্ত করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। ঘুষ নিয়ে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা দেওয়ার অভিযোগে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের দুই সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে দেশটির দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ।

ঢাকার সৌদি দূতাবাসের কনস্যুলার বিভাগের সাবেক প্রধান ও উপরাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ ফালাহ মুদাহি আল-শামারি এবং কনস্যুলার বিভাগের উপপ্রধান খালেদ নাসের আয়েদ আল-কাহতানি- এই দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আট বাংলাদেশীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনজনকে বরখাস্ত করা হয়। ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসের সাবেক দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশী শ্রমিকদের কাছ থেকে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ সৌদি রিয়াল ঘুষ নিয়েছেন, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৫৪ কোটি টাকার সমান।


সৌদি আরবের দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ নাজাহা গত ৪ মার্চ বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে। অ্যারাবিয়া নিউজের বরাত দিয়ে খবরটি প্রথমে প্রকাশ্যে আসার পর জানাজানি হয়। সৌদি আরবের তদারকি ও দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ নাজাহা তাদের টুইটে এ তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশী নাগরিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকার পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ সৌদি সরকার ও সে দেশের দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঘুষের মাধ্যমে অবৈধ ভিসা বাণিজ্যের বিস্তারিত তদন্তের পর বাংলাদেশী নাগরিক আশরাফ উদ্দিন আকনাদ, আলমগীর হোসেন খান, শফিক আল ইসলাম শাহ জাহান, রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক মোহাম্মদ নাসের উদ্দিন নূর, জায়েদ উওসিদ মাফি, আবুল কালাম মোহাম্মদ রফিক আল ইসলাম, আজিজ আলহাক মুসলিম উদ্দিন ও আলামিন খান শহীদ আল্লাহ খান-এই আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।


ঘুষের মাধ্যমে অবৈধ ভিসা বাণিজ্য ছাড়াও গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের বাইরে অর্থপাচারের দায়ে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর আগে কর্মী ভিসা দেওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মাস দুয়েক আগে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারকৃত ঢাকার সৌদি দূতাবাসের কনস্যুলার বিভাগের সাবেক প্রধান ও উপরাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ ফালাহ মুদাহি আল-শামারি এবং কনস্যুলার বিভাগের উপপ্রধান খালেদ নাসের আয়েদ আল-কাহতানি তাদের মধ্যে অন্যতম। ঢাকা ছাড়ার পর তাদের সৌদি আরবে গ্রেপ্তার করা হয়। 
একজন রিক্রুটিং এজেন্ট জানান, হঠাৎ করে সৌদি দূতাবাস একটি নিয়ম করে যে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি সপ্তাহে ২০টির বেশি ভিসা আবেদন জমা দিতে পারবে না। একটি এজেন্সি সপ্তাহে মাত্র একবার ভিসা আবেদন করতে পারে। কিন্তু অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি সপ্তাহে কয়েকশ পাসপোর্ট নিয়ে কাজ করে। ভিসা পেতে এই এজেন্সিগুলো সমস্যায় পড়ে যায়। এজেন্সিগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মীদের ভিসা পাইয়ে দিতে মরিয়া হওয়ায় দূতাবাসের কর্মীরা টাকা নেওয়া শুরু করে। 
অপর একজন রিক্রুটিং এজেন্ট বলেন, এভাবে টাকার বিনিময়ে সৌদি ভিসা দেওয়া শুরু হয়। সংকট থাকার পরও তাদেরকে ডলারে অর্থ দিতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সৌদি কর্মকর্তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর পর ঘুষ আদায় বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকায় সৌদি আরবের সাবেক দুই কূটনীতিক দূতাবাসে দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ভিসা দেওয়ার বিনিময়ে ধাপে ধাপে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ ডলার নিয়েছেন। দুই কূটনীতিক ছাড়াও এই চক্রে থাকা দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তাকেও গ্রেপ্তার করেছে সেখানকার দুর্নীতি দমন বিভাগ নাজাহা। তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা স্বীকার করেছেন যে, ওই ডলারগুলোর ‘একটি অংশ’ তারা গ্রেপ্তার হওয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাধ্যমে সৌদি আরবেই গ্রহণ করেছেন এবং তা দেশটির বাইরে বিনিয়োগ করেছেন।


সৌদি কর্তৃপক্ষ এক টুইটে বলেছে, গ্রেপ্তারের সময় তাদের কয়েকজনের বাড়ি থেকে ৫৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার, স্বর্ণ ও গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা সৌদি আরবের কাজের ভিসা বিক্রির মাধ্যমে এই টাকা পেয়েছে বলে দুর্নীতি দমন বিভাগ মনে করছে। এই ঘটনায় ৮ বাংলাদেশী গ্রেপ্তার হওয়ায় সৌদি আরবে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
২০২২ সালের শুরু থেকে দূতাবাসের কয়েক সৌদি কর্মকর্তা ও বাংলাদেশীদের একটি চক্র প্রতি ভিসার জন্য ২২০ থেকে ২৫০ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বিষয়টি নিয়ে সরাসরি ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দাহিলানের সঙ্গে কথা বলেন। দূতাবাসে ঘুষ নিয়ে বেশ হৈচৈ ও সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশ সরকারের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ডলারে ঘুষ নেওয়া বন্ধ হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি। তবে সৌদি আরব বড় শ্রমবাজার বলে দেশটি নিয়ে বেশ স্পর্শকাতরতা থাকায় সরকার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেনি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে শুধু ২০২২ সালেই সৌদি আরবে গেছেন ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন শ্রমিক। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গেছেন ৮৫ হাজার ৩১৯ জন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর