• বুধবার ০৮ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

  • || ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

লিচু চাষিদের মুখে তৃপ্তির হাসি

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৩১ মে ২০২৩  

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলতি মৌসুমে রসালো ফল লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে লিচু চাষিদের মুখে এখন তৃপ্তির হাসি। দাম নাগালের মধ্যে থাকায় বেচা-বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। এ জেলার লিচু মিষ্টি ও রসালো হওয়ায় দেশজুড়ে রয়েছে সুনাম ও খ্যাতি। এদিকে, লিচু বাগানে প্রতিদিন শত শত মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসছে। এ যেন এক উৎসবের আমেজ। কেউ আবার শখ করে লিচু বাগানে ছবি তোলা দিয়ে ব্যস্ত, কেউ লিচু গাছ থেকে লিচু পারা নিয়ে ব্যস্ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৫৬৭ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ করা হয়েছে। এ বছর জেলাতে প্রায় ২৪ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করা হবে। জেলায় সীমান্তবর্তী বিজয়নগর, আখাউড়া ও কসবা উপজেলায় বেশি লিচুর চাষ করা হয়েছে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০২ সাল থেকে বিজয়নগর উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লিচুর আবাদ করা শুরু হয়। কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় এখানকার ধানী জমিগুলোকেও লিচু বাগানে পরিণত করতে থাকেন চাষিরা। বর্তমানে বিজয়নগর উপজেলায় পাহাড়পুর, বিষ্ণুপুর, কাঞ্চনপুর, খাটিঙ্গা, কাশিমপুর, সিঙ্গারবিল, চম্পকনগর, আদমপুর, কালাছড়া, মেরাশানী, সেজামুড়া, কামালমোড়া, নুরপুর, হরষপুর, মুকুন্দপুর, নোয়াগাঁও, অলিপুর, চান্দপুর, কাশিনগর, ছতুরপুর, রূপা, শান্তামোড়া, কামালপুর, কচুয়ামোড়া, ভিটিদাউপুর এলাকায়  প্রায় চার শতাধিক লিচুর বাগান রয়েছে। এসব বাগানে দেশি লিচু, এলাচি লিচু, চায়না লিচু, পাটনাই লিচু ও বোম্বাই লিচু চাষ করা হয়।

এছাড়াও উপজেলার প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই একটি করে লিচু গাছ আছে। যাদের বাড়িতেই একটু জায়গা আছে, তারা প্রত্যেকেই বাড়িতে অন্যান্য ফলের গাছের সঙ্গে লিচু গাছ লাগান।

এলাকাবাসী ও চাষিরা জানান, লিচু গাছে মুকুল আসার পর থেকে কয়েক দফা বাগান বিক্রি হয়। গাছে মুকুল ও গুটি আসার পর প্রথমে বাগান কেনেন স্থানীয় ও বিভিন্ন জেলার মহাজনরা। গুটি একটু বড় হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় গাছ বিক্রি হয়। লিচু আকার ধারণ করলে তৃতীয় দফায় বিক্রি হয়। লিচু বড় হলে চতুর্থ দফায় বাগান বিক্রি হয়।

বিজয়নগর উপজেলার সবচেয়ে বড় লিচুর বাজার হচ্ছে আউলিয়া বাজার। এছাড়াও উপজেলার মেরাশানী, মুকুন্দপুর, কাংকইরা বাজার, চম্পকনগর, সিঙ্গারবিল বাজার, আমতলী বাজারসহ আরো কয়েকটি বাজারে পাইকারিভাবে লিচু বেচা-কেনা হয়। প্রতিদিন ভোর রাত ৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এসব বাজারে লিচু বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন উপজেলার আউলিয়া বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে প্রায় ২০-২২ লাখ টাকার লিচু বেচা-কেনা হয়।


এসব বাজার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নরসিংদী, ভৈরব, নোয়াখালী, চাদপুর, মৌলভীবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ, ফেনী ও রাজধানী ঢাকার ব্যবসায়ীরা লিচু কেনে বিভিন্ন যানবাহনে করে নিয়ে যায়।

ব্যবসায়ীরা জানান, উপজেলার আউলিয়া বাজারসহ অন্যান্য বাজারগুলোতে বর্তমানে প্রতি হাজার দেশি লিচু ২ হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা, প্রতি হাজার এলাচি ও চায়না লিচু ২-৩ হাজার টাকা, পাটনাই ও বোম্বাই লিচু ২২০০-২৫০০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।


বিজয়নগরের বিষ্ণুপুর ইউপির মহেশপুর গ্রামের লিচু চাষি মাসুদুল হাসান বলেন, প্রথম থেকে গাছের পরিচর্যা করে আসছি। গাছে মুকুল আসার পর থেকে গাছের নিচে কীটনাশক ও পানি দিতে হয়। এবার আবহাওয়া একটু বিরূপ ছিল। বৃষ্টি হলে আরেকটু ভালো লিচু হতো, তারপরও বেশ ভালো ফলন হয়েছে। এ বছর ৩ কানি জমিতে ৬০টা গাছে লিচু চাষ করা হয়েছে। লিচু আবাদ করতে তার ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিটা গাছে লিচু ভালো আসায় প্রায় ১০-১২ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করা সম্ভব হবে। গত বছর সে ৯ লাখ টাকা লিচু বিক্রি করে।

কামালমুড়া গ্রামের লিচুর চাষি শফিকুল ইসলাম জানান, তার দুইটা বাগানে ৬০টি লিচু গাছ আছে। গত ১০-১২দিন ধরে তিনি আউলিয়া বাজারে লিচু বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছেন তিনি। এ বছর প্রচুর গরমে লিচু অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে আরো ভালো ফলন হতো, তার পরেও ভালো ফলন হয়েছে। তার বাগানে যে পরিমাণ লিচু আছে আরো ৭-৮ দিন বিক্রি করতে পারবেন।

ভৈরবের লিচুর পাইকার দুলাল মিয়া জানান, গত ৫ দিন ধরে তিনি বাজারে ও বাগানে আসছেন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় লাখ টাকার লিচু তিনি কেনেন। এখানকার লিচু ভালো ও মিষ্টি হওয়ায় লিচু বিক্রি করে তিনি লাভবান হচ্ছেন। এখানের লিচুর বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবার ব্যবসায়ী কালু হোসন জানান, গত ১৫ দিন ধরে তিনি আউলিয়া বাজারসহ বিভিন্ন বাগানে আসছেন। প্রতিদিন তিনি গড়ে প্রায় লাখ টাকার উপরে লিচু কেনেন। তিনি বলেন, লাভ একটু কম হলেও এখানকার লিচু অনেক ভালো ও মিষ্টি হওয়ায় চাহিদা থাকে বেশি।


বিষ্ণুপুর ইউপির মহেশপু লিচু বাগানে স্বমীসহ ঘুরতে আসা ফাতেমা বেগম বলেন, প্রতি বছরই ফেইসবুকে বিভিন্ন জন লিচু বাগানে ঘুরতে যাওয়ার ছবি দেয়। আমার স্বামী প্রবাসী। এবার স্বামী দেশে থাকায় স্বামীকে নিয়ে এই প্রথম লিচু বাগানে ঘুরতে এসেছি। এসে নিজের মত করে বাগানে ছবি তোলছি। এসে মনে হচ্ছে আগে কেনো আসেনি। এ যেনো প্রাকৃতির এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য।

এ ব্যাপারে বিজয়নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিমল কর্মকার বলেন, লিচু বাজার ও বাগানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন যাতে সুন্দরভাবে লিচু ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেন সেদিকে পুলিশের মোবাইল টিম সার্বক্ষণিক কাজ করছেন।


এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশিক্ষণ অফিসার মুনসি তোফায়েল হোসেন বলেন, লিচুর ভালো ফলনের জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বাগান মালিকদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৬৭ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ করা হয়েছে। জেলার ৯ উপজেরার মধ্যে সীমান্তবর্তী উপজেলা বিজয়নগর, আখাউড়া ও কসবায় বেশি লিচুর চাষ করা হয়েছে। এ বছর জেলাতে প্রায় ২৪ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করা হবে।

তিনি আরো বলেন, আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি। প্রতি বছরই লিচু চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর