• বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩১ ১৪৩১

  • || ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

প্রযুক্তির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ডাকবাক্স

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

ডিজিটাল প্রযুক্তির দাপটে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বর্তমানে ডাক বাক্সের কদর নেই বললেই চলে। কেননা আধুনিকতার ছোঁয়ায় ডাক বাক্সের চাহিদা ও ব্যবহার দুটোই যেন অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। ফলে ব্যবহার না হতে হতে এসব ডাকবাক্সগুলো এখন অযত্ন ও অবহেলায় ভেঙে পড়ে রয়েছে অফিসের পরিত্যক্ত রুমের এক কোণায়।
স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার মো. আব্দুল মালেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে ডাকবাক্সগুলো চিঠিতে ভরে থাকতো। প্রতিদিন এটি দুইবার খোলা হতো। লোকজন ডাক বাক্সে চিঠি ফেলে দিয়ে কবে তার প্রিয়জন সেই চিঠি পাবেন তা জিজ্ঞাসা করতেন এবং ফিরতি চিঠিরও খোঁজ করতেন। কিন্তু এই অপেক্ষা এখন আর কেউই করেন না। মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রিয়জনের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যসহ সবাই দ্রুত ভাব বিনিময় করে ফেলেন। তবে চিঠির লিখুনির মাধ্যমে প্রিয়জনের আবেগতাড়িত ভালোবাসার কথা আজ মোবাইল কিংবা ই-মেইলে তেমনভাবে ফুটে উঠে না।

এ বিষয়ে মাধখলা মাদরাসার বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মো. ফজলুল হক জানান, ৯০ দশকে প্রিয়জনের কাছ থেকে হাতে পাওয়া সেই চিঠির জন্য অপেক্ষা কি যে মধুর ছিলো তখনকার প্রিয়জনরাই তা অনুভব করতেন। স্ত্রী, স্বামির কাছে এখন আর আবেগতাড়িত হয়ে কোনো চিঠি যেমন লেখেন না, অনুরুপভাবে মা তার সন্তানদের কাছে কিংবা কোনো তরুণ তরুণী তার প্রিয়জনের কাছে চিঠি লিখে ডাক বাক্সে দিয়ে আসেন না। বর্তমান সময়ের মানুষরা তার প্রিয়জনের কাছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে ফেলছেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের মানসিকতাও পাল্টে গেছে। সময় নষ্ট করে আর কেউ যেমন চিঠি লেখেন না, তেমনি চিঠি অনেক দেরি করে প্রিয়জনের হাতে পৌঁছে যাক এটাও কেউ চায় না।

কালের গর্ভে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনের কাছে হাতে লিখা চিঠি আর জৌলুস ছড়ানো ডাক বাক্সের কদর। এখন ডাক বাক্সে সরকারি চিঠি পত্র ছাড়া আর কোনো চিঠিই পাওয়া যায় না।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে হোসেনপুর সরকারি পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মো. তোরাব আলী জানান, আগে মনের ভাব আদান প্রদান ক্ষেত্রে ডাক বিভাগের নাম অতি গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হতো। স্বাধীনতার পর নব্বই দশক পর্যন্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি এবং জরুরি বার্তার জন্য টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন। একমাত্র জেলা শহর ব্যতীত গ্রামীণ জনপদে টেলিফোনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সীমিত। পরিবার কিংবা প্রিয়জনের চিঠির জন্য অপেক্ষায় থাকতেন প্রবাসীরাও। কিন্তু এখন আর সেইসব চিত্র চোখে পড়ে না। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে দিন বদলের ন্যায় পাল্টে গেছে সবকিছু। এখন এক নিমিশে খবরা খবর পৌঁছে যাচ্ছে ঘর থেকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে। প্রতি সেকেন্ডে সচিত্র আলাপ চলছে অত্যাধুনিক মোবাইলে। চোখের পলকে খবর পৌঁছে যাচ্ছে ই-মেইলে। মুলতঃ ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনের ফলে অচল হয়ে গেছে ডাক বিভাগের চিঠি প্রেরণ ও টেলিগ্রাফ কার্যক্রম।

১৮৬৩ সালে আমেরিকায় প্রথম ডাক বিভাগের প্রবর্তন ঘটলেও ১৮৭৪ সাল থেকে গঠিত হয় জেনারেল পোস্টাল ইউনিয়ন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ডাক বিভাগের কার্যক্রম একটা সময় বেশ জোরেশোরে চললেও এখন আর পূর্বের মতো অবস্থা নেই। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি কারণে এবং বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের দাপটে ডাক বিভাগের আগের ব্যস্ততা কমে গেছে। অথচ এক সময় দেশ বিদেশ থেকে চিঠি পত্রের আদান প্রদান এবং টাকা প্রেরণের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম ছিল ডাক বিভাগ। সে সময়ে ডাক বিভাগের কদর ছিল অন্য রকম। এখন তথ্য প্রযুক্তির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সেই পুরোনো ডাক যোগাযোগ। দূরত্ব আর এলাকার ধরণের ওপর নির্ভর করতো ডাকযোগে কোনো জিনিস কয় দিনে পৌঁছবে। এখন সে অপেক্ষা আর করতে হয় না। অনায়াসে পৌঁছে যায় প্রিয়জন কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে খবরাখবর বা অন্যান্য জিনিস পত্র।

স্থানীয় প্রবীণ সাংবাদিক মো. আব্দুল মতিন মাস্টার বলেন, রাতে সংবাদ লিখে খোলা চিঠির খামে ভরে ডাকবাক্সে ফেলে দিতাম। কয়েকদিন পর ওই সংবাদ ছাপা হতো। এরপর পত্রিকা অফিস ডাকযোগে সেই পত্রিকা  পাঠাতো, সেই ছাপানো খবর পড়ার জন্য কখন ডাক পিয়ন ডাকবাক্স খুলবে তার জন্য আগে থেকে পোস্ট অফিসে এসে অপেক্ষা করতো সংবাদ কর্মীরা। এ সবই যেন এখন কালের সাক্ষী। 

হোসেনপুর উপজেলা পোস্ট অফিসে কর্মরত অনেকেই জানান, বর্তমানে চিঠি পত্রের আদান প্রদান কমে গেলেও এখনো সরকারি বিভিন্ন দফতরের কাজ চিঠির মাধ্যমেই করে থাকেন। এ ছাড়া তথ্য প্রযুক্তির অনেক কাজও পোস্ট অফিসের মাধ্যমে করতে হচ্ছে বিধায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর