• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

কলা চাষে নতুন দিগন্তের উন্মোচন

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০২৩  

অসুস্থ রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহার থেকে শুরু করে, স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের দৈনন্দিন পুষ্টিকর খাবার হিসেবে ‘কলা’র কদর ক্রমশই বাড়ছে। ওষুধি গুণসম্পন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর কলার চাহিদাও তাই তুঙ্গে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজশাহীতে কলার আবাদ ও উৎপাদন উভয় বেড়েছে। বাণ্যিজিকভাবে শুরু হওয়া কলা চাষে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন চাষি। এতে কলা উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপনণেও স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান বাড়ছে। বাসা-বাড়ির পতিত জমিসহ সমন্বিত পদ্ধতিতেও ব্যাপক কলা চাষ হচ্ছে। এছাড়া কলার নতুন জাত উদ্ভাবনেও অভাবনীয় সাফল্য এনেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। সবমিলিয়ে  রাজশাহীতে কলা চাষে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কলা যেমন মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী ফল, তেমনি এটির চাষও লাভজনক। কলা চাষে উৎপাদন খরচ কম। শ্রম কম। ফলন ভালো। আর ব্যাপক চাহিদা থাকায় দামও ভালো পাওয়া যায়। কলা চাষ করে সাধারণ কৃষকরা লোকসান গুনেন না। পারিবারির পুষ্টি চাহিদা পূরণেও কলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গবেষণায় সাফল্যও কলা চাষকে উৎসাহিত করছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় ‘কলা’ ফল হিসেবে বিপ্লব ঘটাচ্ছে।  

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজশাহী জেলায় করোনাকালীন সময় থেকে কলা চাষে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। রাজশাহী জেলায় ২০১৭-১৮ অর্থ-বছরে ১ হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে কলার চাষ হয়েছিলো। যেখানে উৎপাদন ছিল ৬১ হাজার ৭৫৬ মেট্রিক টন। এ সময় হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ৩০ দশমিক ৬০ মেট্রিকটন। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ২৫ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়ে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৪৯১ মেট্রিক টন। 

২০১৯-২০ অর্থ-বছরে ১ হাজার ৯৬২ হেক্টরে জমিতে ৬২ হাজার ৪০৪ মেট্রিক টন কলা উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ মৌসুমে ১ হাজার ৯৭৩ হেক্টর জমিতে কলার উৎপাদন হয়েছিলো ৬৪ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন। এ সময় হেক্টরপ্রতি গড় ফলনও বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৪৭ মেট্রিক  টনে। ২০২১-২২ অর্থ-বছরে জেলায় ৪৩৭ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন দাঁড়ায় ৭৮ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টনে। এ সময় ১ বছরের ব্যবধানে ১৪ হাজার ৭১৭ মেট্রিক টন উৎপাদন বেড়ে যায়। গড় ফলনও বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৮৯ মেট্রিক টন। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে ২ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৬৫৩ মেট্রিক টন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে আবাদকৃত জমির পরিমাণ বাড়ছে, অন্যদিকে উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের আবাদ বাড়ছে। একারণে কলার উৎপাদনও আশনরুপ।

পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ এলাকার কৃষক আলাউদ্দিন মণ্ডল বাড়ির পাশে ৩ বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন। প্রথম বছরেই কলা বিক্রি করে তিনি লাভ করেছেন ৫ লাখ টাকা। তিনি জানান, আমচাষ ছেড়ে তিনি কলা চাষ ধরেছেন। আমের চেয়ে কলা এখন লাভজনক। কলাচাষে ঝামেলা কম। চাহিদাও প্রচুর। পাইকাররা কলা বাগানে এসে অগ্রিম টাকা দিয়ে কলার কাঁদি কিনে নিয়ে যান। ভবিষ্যতে তিনি আরও কলা চাষ বাড়াবেন।

কলার স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাও সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত কলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে নিয়মিত। শনি ও মঙ্গলবার জেলার বানেশ্বর এবং সোম ও বৃহস্পতিবার ঝলমলিয়া হাটে নিয়মিত কলার হাট বসছে। যেখানে পণ্যবাহী ট্রাকে করে ব্যবসায়ীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কলা নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিহাটে এই বাজারে কোটি টাকার কলা বেচাকেনা হয় বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগ। এছাড়া রাজশাহীর স্থানীয় বাজারে খুচরা পর্যায়ে ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা পিস ও ২০ থেকে ৪০ টাকা হালি দরে কলা বিক্রি হচ্ছে।

গবেষণায় নতুন দিগন্ত: চাষী পর্যায়ে কলা চাষে রোগমুক্ত চারা ও অধিক উৎপাদন নিয়ে ২০১৭ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। কৃষক পর্যায়ে রঙিলা সাগর, নীল সাগর, গ্রান্ড-নাইন, সবরি ও অগ্নিশ্বর; এই পাঁচ জাতের কলার টিস্যু কালচারের মাধ্যমে সম্প্রতি জি-৯ নামে নতুন জাতের চারা উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক দল। তাদের দাবি, উদ্ভাবিত জাতটি রোগমুক্ত, সাধারণ জাতের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল।

ওই গবেষক দলের প্রধান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, মাইক্রোপ্রোপাগেশন পদ্ধতিতে বিভিন্ন জাতের কলার টিস্যু কালচার চারা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। খাদ্য ও কৃষি পণ্যের উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে কলার অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশসহ ভারত বিশ্বে কলা উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে। এসব দেশ কলা রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। কিন্তু বাংলাদেশের কলা ফেটে যাওয়া, কলার গায়ে কালো দাগ পড়া, কলার প্রমিত ও পর্যায়িতকরণ না থাকা, কলাতে মাত্রারিক্ত কীটনাশকের উপস্থিতির কারণে রফতানির শর্ত পূরণ করতে পারে না। তবে রাবিতে উদ্ভাবিত টিস্যু কালচার পদ্ধতির কলার চারা শতভাগ রোগ-জীবাণুমুক্ত। যা রফতানিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

তিনি আরো বলেন, দেশের কৃষকদের পাঁচ জাতের চারা স্বল্পমূল্যে-বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কৃষকদের কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া মিলেছে। বেসরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে টিস্যু কালচার ল্যাবে চারা উৎপাদন করা সম্ভব।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, কলার পুষ্টিগুণ বিবেচনায় চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি লাভজনক হওয়ায় চাষও বেড়েছে। এর সঙ্গে রাবির গবেষকদের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের কলার চারা। সবমিলিয়ে কলা চাষ খুব ভালো আশাব্যাঞ্জক ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর