• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

শিক্ষার আলো ছড়ানো এক বাতিঘর অধ্যক্ষ মাহাতাব

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০২৩  

পাবনা জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত জনপদে তিনি শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, গার্লস হাইস্কুল, মাদরাসা গড়ে তুলেছেন। ৭৭ বছর বয়সে এসেও তিনি স্বপ্ন দেখছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। এজন্য ভবন নির্মাণ- জমি প্রদানসহ অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করেছেন। তিনি তার শৈশব পার করা পাবনার দুবলিয়া- চরতারাপুর এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এজন্য তাকে ‘আলোকিত দুবলিয়া’র রূপকার বলা হয়। এ আলোকিত ব্যক্তিত্ব হলেন পাবনা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস। 
তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পাবনা সদর উপজেলার চরতারাপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবা হাজী জসীম উদ্দিন বিশ্বাস। মাতা ফজিলাতুন্নেছা। তার পিতা ছিলেন এলাকার অন্যতম ধনাঢ্য ও দানবীর। তার মা ছিলেন একজন মহীয়সী রমণী। তাদের ঘরের ছোট ছেলে ‘মাহাতাব বিশ্বাস।’

ছোটবেলা থেকেই মাহাতাব বিশ্বাস সামাজিক ও জনহিতকর কাজে ছিলেন অগ্রণী। স্বপ্ন দেখতেন এলাকার মানুষের উন্নয়নের। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, গার্লস হাই স্কুল থেকে শুরু করে একাধিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি পাবনা কলেজ, দুবলিয়ায় হাজী জসিম উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ, পদ্মা কলেজ, ফজিলাতুন্নেছা গার্লস হাইস্কুলসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। যশস্বী এই শিক্ষাবিদ, জনদরদী ব্যক্তি অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস পাবনা জেলায় এক নামে পরিচিত।

অধ্যক্ষ মাহাতাব বিশ্বাস জানান, প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন পাবনার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া হাইস্কুলে। ২ কিলোমিটার হেঁটে আসতে হতো। জানালেন, তখন ভাবতাম যদি বাড়ির কাছে একটা স্কুল থাকতো, তবে কতই না ভালো হত! তিনি বুকে স্বপ্ন লালন করতে থাকেন এলাকায় স্কুল-কলেজ করার। তার জীবনে সে সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে জানান। 

এদিকে খালাবাড়িতে এক বছর পড়ার পর পাবনা শহরে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন পাবনার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জিসিআইতে। হাইস্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন এডওয়ার্ড কলেজে। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি বিপুল ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি পাবনা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে পাবনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময় তিনি শতাধিক প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।  

অধ্যক্ষ মাহাতাব বিশ্বাসকে বলা হয় আলোকিত দুবলিয়ার রূপকার। পাবনা শহর থেকে ১৫-১৬ কিলোমিটার পূবে অবস্থিত দুবলিয়া। কৃষি, স্বাস্থ্য, যোগযোগ ও শিক্ষায় এক সময়ের পশ্চাদপদ এ এলাকাতে সত্যিকারের পূবের হাওয়া লাগিয়েছিলেন অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস। সে দিনের সেই অজো পাড়া- গাঁ যেখানে বলতে গেলে প্রাথমিক শিক্ষার সুব্যবস্থা ছিল না সেখানে আজ হাইস্কুল, নারী শিক্ষার প্রসারে গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর উচ্চ শিক্ষার দিগন্ত খুলে দিয়েছে ডিগ্রি (অনার্স) কলেজ। 

দুবলিয়া ফজিলাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল খালেক খাঁন জানান, দুবলিয়া এলাকার এগিয়ে যাওয়ার পালে হাওয়া লাগিয়ে দিয়েছেন অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস। 

পাবনা- সুজানগর সড়কের পাশে প্রায় দুই একর জায়গার উপর অবস্থিত ফজিলাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এটি তার মায়ের নামে (ফজিলাতুন্নেছা) প্রতিষ্ঠা করেন। নারী শিক্ষার উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। 

১৯৫৭ সালে দুবলিয়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি জুনিয়র হাইস্কুল ছিল। ফলে অনেকের পক্ষেই এসএসসি পাশ করা হয়ে উঠত না। অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস এটিকে পূর্ণাঙ্গ হাইস্কুল করার ব্যবস্থা করেন। 

উচ্চ শিক্ষার দিগন্ত খুলে দিয়েছে হাজী জসীম উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ। ১৯৮৪ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অধ্যক্ষ (অব) মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাসের ইচ্ছায় ও প্রচেষ্টায় কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দুবলিয়ায় তাঁর পিতার নামে এ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকার ত্যাগী ব্যক্তি এবং শিক্ষকমন্ডলীর চেষ্টায় তিলে তিলে উন্নতি করেছে হাজী জসীম উদ্দিন ডিগ্রি (অনার্স) কলেজ। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত এ কলেজটি ২০০০ সালে ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।  

তিনি ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সহযোগীদের নিয়ে পাবনা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন জেলার অন্যতম সেরা কলেজ এটি। তিনি এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন।

পাবনা কলেজ ছাড়াও পাবনার সরকারী শহীদ বুলবুল কলেজ ও পাবনা মহিলা কলেজ সরকারিকরণে অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাসের বিরাট অবদান ছিল। প্রথম পর্যায়ে পাবনা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার শ্রম ছিল অতুলনীয়। পদ্মা কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পাবনা আবাসিক কোরানীয়া মাদরাসাসহ  অনেকগুলো মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

তিনি শুধু পৈত্রিক এলাকায় বা শহরে স্কুল কলেজ গড়ে তোলেননি। তিনি প্রত্যন্ত চরের মানুষের বন্ধুজন হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। পিছিয়ে ছিল পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা, চরকোমরপুর, চর আশুতোষপুর এর শিক্ষার্থীরা। অনেক নিচে ছিল শিক্ষার হার। দুরদর্শী মাহাতাব বিশ্বাস চরে ভাড়ারা রেজি: বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিদ্যালয়, পদ্মা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দৃশ্যপট পাল্টে দেন। 
 
দুবলিয়া ফজিলাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানাউল্লাহ খাঁন রাজু বলেন, মাহাতাব বিশ্বাসের অসামান্য অবদানের কথা দুবলিয়াবাসী ভোলেননি। তিনি নিজেও অধ্যক্ষ বিশ্বাসের অনেক উন্নয়ন কাজের প্রত্যক্ষদর্শী। 

চরতারাপুর ইউনিয়নের চেয়াম্যান ও দুবলিয়া ফজিলাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, দুবলিয়া- চরতারাপুর এলাকা এক সময় অনুন্নত ছিল। শিক্ষায়ও পিছিয়ে ছিল। সেই পশ্চাদপদ এলাকার উন্নয়নে অগ্রনায়ক অধ্যক্ষ মাহাতাব বিশ্বাস।
 
দুবলিয়া হাজী জসীম উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি ফুরকান রেজা বাদশা বিশ্বাস বলেন, অধ্যক্ষ মাহাতাব বিশ্বাস এর মত ক্ষণজন্মা মানুষ প্রতি বছর কোনো পরিবারে জন্ম নেয় না। শতাব্দীতে জন্ম নেয়। 

পাবনা -৫ (সদর) আসনের এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, মাহাতাব বিশ্বাস যে পরিবারের মানুষ সে বংশের ঐতিহ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। দুবলিয়া এলাকায় গেলেই তার নমুনা দেখি। এসব প্রতিষ্ঠান যতদিন থাকবে ততদিন থাকবে তার কীর্তি গাঁথা। 

অধ্যক্ষ মাহাতাব বিশ্বাস জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়া তার শেষ জীবনের একটি স্বপ্ন। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তিনি নিজ জায়গার ওপর এরই মধ্যে ১০ তলা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেছেন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর