• শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২১ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা বদলে দিয়েছে রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রাম

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩  

‘দুনিয়াত কি আর খেলা নাই, বেটি ছুয়ালাক (মেয়েদের) ফুটবল খেলিবা হবে। তাও ফের ছোট ছোট কাপড় পিন্দেহেনে৷ শরম-লইজ্জা সব উঠে গেইল। এলাকার সব মানসম্মান বেটি ছুয়ালা ডুবাই দিল।’ এমন সব কথার মাধমেই প্রতিনিয়ত কটাক্ষ আর বিদ্রুপের শিকার হতে হতো ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি নারী ফুটবল একাডেমির সদস্যদের। সব কটাক্ষ আর বিদ্রুপকে লাল কার্ড দেখিয়ে এগিয়ে গেছে মেয়ে ফুটবলার। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে খেলছেন জাতীয় দলে হয়েছেনও দেশসেরা ফুটবলার। একটা সময় যারা কটাক্ষ করতো তারাই এখন তাদের মেয়েদের নিয়ে সেই রাঙ্গাটুঙ্গী মাঠে। ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রাম। গ্রামের পাশে মেঠো পথের পাশে সেই রাঙ্গাটুঙ্গি মাঠ। ২০১৪ সালে হাতেগোনা ছয় জন মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় ফুটবলের যাত্রা। নাম দেওয়া হয় রাঙ্গাটুঙ্গি নারী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। মেয়েরা ফুটবল খেলবে মানেই এক শ্রেণির মানুষের কাছে তা ছিল কটাক্ষ, বিদ্রুপ আর উপহাসের। শুরুতেই নানা ধাক্কা পেলেও থমকে যায়নি তাদের গতি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। আর তাদের ঝুলিতে যুক্ত হতে থাকে নানা সফলতা। সফলতার শুরুটা হয়েছিল জেলা পর্যায়ে চাম্পিয়ন হয়ে। তারপরে বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে সুনাম বয়ে নিয়ে আসে রাঙ্গাটুঙ্গি মাঠের মেয়েরা। গত বছর মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয় বাংলাদেশ। নারী সাফ বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানী। তারা রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড়। সোহাগী আর স্বপ্না রানী ছাড়াও জাতীয় দলে একাডেমির কোহাতি কিসকুও রয়েছেন। অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলছে সাগরিকা ও অনন্য মুরমু। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৭ নারী সাফ ফুটবলে নেপালের সঙ্গে পিছিয়ে থাকা খেলায় বাংলাদেশের পক্ষে গোল করে সমতা এনেছিল এই সাগরিকা। জাতীয় দলে এ মাঠ থেকে বিভিন্ন সময়ে ১৩ জন ফুটবলার খেলার সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে তিনজন জাতীয় দলে ও অনূর্ধ্ব-১৭ তে দুইজন ফুটবলার খেলছেন৷ এ ছাড়াও বিদেশর মাঠে ৫ জন ও দেশের বিভিন্ন লীগে খেলার সুযোগ পেয়েছেন ১৭ জন ফুটবলার৷ নারী ফুটবলার কাকলী আক্তার বলেন, আমরা এখানে খেলার কারণে প্রতিবেশী থেকে শুরু করে অনেকজনে আমাদের সামনে কটাক্ষ করেছে। আমরা নাকি সমাজের মানসম্মান নষ্ট করে দিলাম। ছোট কাপড় পড়ে নাকি লাজ লজ্জা উঠে গেছে আমাদের। আরো অনেক কথা শোনতে হয়েছে। তবে এখন আর কেউ কথা বলে না। এক সময় যারা আমাদের নিয়ে কথা বলতো তারা এখন তাদের মেয়েদের নিয়ে আসে মাঠে ফুটবলার বানানো জন্য। আমরা এ মাঠ থেকে একটা সময় আরো ফুটবলে ভালো কিছু করতে পারব। মাঠের পাশে মেয়ের খেলা দেখা অভিভাবক মহসিন আলী বলেন, শুরুতে আমরা অনেকে অনেক কথা বলেছি। পরে দেখলাম মেয়েরা দেশ-বিদেশে আমাদের সুনাম বয়ে নিয়ে আসছে। তারা আর পেছনে পড়েনি। সে কারণে আমিও আমার মেয়েকে ফুটবলার বানানোর জন্য মাঠে পাঠাই। দলটির কোচ সুগা মরমু বলেন, আমি আমার সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দক্ষ ফুটবলার হিসেবে তাদের গড়ে তোলার। তারা ভালো করছে আগামীতে আরো ভালো করবে। যদি এখানে আরো মানসম্মত কোচ দেওয়া হয় তবে তারা আরো ভালো শিখতে পারবে। নারী ফুটবল দলটির পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, কয়েকজন মেয়ে নিয়ে ফুটবল দলটির যাত্রা শুরু করেছিলাম। সবার সার্বিক সহযোগিতা আর মেয়েদের চেষ্টায় আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি। আমাদের প্রত্যাশা আরো অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার। এখানে যারা অনুশীলন করেন তারা সকলে একেবারে নিম্ন বিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। যে দুজন জাতীয় দলে খেলছেন তারা আদিবাসী পরিবারের৷ এছাড়াও যারা রয়েছেন তারা সকলে খেটে-খাওয়া পরিবার থেকে উঠে আসা। সে কারণে তাদের শারীরিকভাবে উপযুক্ত থাকার জন্য যা দরকার তা আমরা দিতে ব্যর্থ হলেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে অনেকজনের কটুকথা শোনতে হয়েছে। সব উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আগামীতে এ মাঠ থেকে আরো দেশসেরা ফুটবলার তৈরি হবে বলে আশা করছি। সেই সঙ্গে মেয়েদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আহবান করছি। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, নারী ফুটবলাররা আমাদের দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা তাদের ওয়াসব্লক করে দিয়েছি। যাতে তারা আরো ভালো করে অনুশীলন চালিয়ে নিতে পারে। আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক তত্ত্বাবধান করা হবে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর