• বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

  • || ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

মধুপুরে হারিয়ে যাচ্ছে সাংসারেক গারোদের ঐতিহ্য খিম্মা রীতি

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩  

ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের গারো পাহাড়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি গারো সম্প্রদায়ের বসবাস। খাসিয়াদের পরেই গারোরা মেঘালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৃ জনগোষ্ঠী। গারোরা সাধারণত নিজেদেরকে মান্দি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মান্দি শব্দের অর্থ মানুষ। বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসবাস করা গারোরা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব উত্তরকে আপাল আর পশ্চিম দক্ষিণ অংশ আবিমা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। গারো সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এছাড়াও অন্যান্য দেবতা মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়াসহ অনেক দেবতার পূজা করে থাকেন। সাংসারেক রীতি অনুসারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান রীতি-নীতি পালন করা হতো। এখন খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে তাদের আদি সাংসারেক ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে যাচ্ছে। এক সময় সাংসারেক গারোদের ‘খিম্মা সঙা’ প্রথা ছিল। খিম্মা বা খাম্মা গারো বা আচিক শব্দের অর্থ স্মৃতিস্তম্ভ। সঙা হলো পোতা। সাংসারেক গারোদের প্রচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী কোন মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির স্মৃতি রক্ষার্থে এ খিম্মা সঙা করা হতো। কাঠের খোদাই করা খুঁটি দিয়ে খিম্মা দেয়া হতো। খিম্মায় সাংসারেক প্রথা অনুসারে ৫ বা ৭ টি খাঁচ রাখা হতো। মৃত ব্যক্তি পুরুষ হলে খিম্মার উপর দিকে জাংগি বা খাচ রাখা হতো। আর নারী হলে নিচের দিকে জাংগি বা খাচ রাখা হতো। খিম্মার উপরের দিকে মাথার মতো রাখা হয়। খিম্মা পুঁতে রাখা হতো বাড়ির উঠানের সামনের এক কোনে। নারী পুরুষ ভেদে পালন করা হতো নানাবিধ নিয়মকানুন। নারী হলে নারীদের পোষাক, শাড়ী, গহনা আর পুরুষ হলে ধূতি, খুতুপ ইত্যাদি খিম্মায় পড়িয়ে রাখা হতো। সাংসারেক ঐতিহ্য মতে আরো অনেক নিয়ম অনুযায়ী মানা হতো। খিম্মা প্রথা গারোদের ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাচীন প্রথা। এক সময় এ প্রথা সাংসারেক গারোরা পালন করতো। ধীরে ধীরে এ খিম্মা বা খাম্মা প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য এলাকায় তেমন দেখা না গেলেও মধুপুর এলাকায় এক সময় অনেক বাড়িতে ছিল। তবে এখন আর আগের মতো নেই। খিম্মা প্রথা কমে যাচ্ছে। মধুপুরের বিভিন্ন গারো পল্লী ঘুরে তাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। মধুপুর আবিমা অঞ্চলে বিভিন্ন গারো পল্লীর কিছু কিছু বাড়িতে এ খিম্মা দেখা যায়। আবার অনেক বাড়িতেই খিম্মা নেই। মধুপুরের গারোদের প্রতিনিধিত্বকারি সংগঠনের কার্যালয়ের সামনে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত পরেশ মৃ’র খিম্মা স্থাপন করেছে। তার স্মৃতি রাখার জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে এ খিম্মা স্থাপন করা হয়। পাহাড়িয়া এলাকার চুনিয়া গ্রামে সাংসারেক গারো খামাল বা পুরোহিত প্রয়াত জনিক নকরেকের বাড়িতেও খিম্মা প্রথা রয়েছে। তিনি ছিলেন মধুপুর আবিমা অঞ্চলের সাংসারেক গারোদের খামাল বা পুরোহিত। সাইসনামারি গ্রামে প্রয়াত রাগেন্দ্র নকমার বাড়িতেও রয়েছে খিম্মা। শহীদ পীরেনের নামেও বন এলাকার ঝালাবাঁধায় করা হয়েছে খিম্মা। এভাবে সাংসারেক গারোদের ঐতিহ্য কিছু কিছু বাড়িতে দেখা গেলেও এ খিম্মা প্রথাটি অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। গাছাবাড়ি ফাতেমা রানী মিশনারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ঝুমুর আজিম বলেন, আগে তাদের সাংসারেকরা এটা পালন করতো। তিনি খিম্মা সম্পর্কে শুনেছেন এবং খিম্মা স্থাপন করতে দেখেছেন। তবে নিজে করেননি। জিবিসি মিশন বোর্ডে ডিরেক্টর ফাস্টার মধুনাথ সাংমা বলেন, খাম্মা প্রথা তার দাদা নানীরা করতো। এটা মুলত সাংসারেক গারোদের প্রথা। তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় তাদের ব্যাপ্টিস্ট গারোরা এখন আর খিম্মা বা খাম্মা স্থাপন করে না। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে খিম্মা পুঁতা বা স্মৃতি ফলক। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি নেতা ইউজিন নকরেক বলেন, সাংসারেক গারোরা যখন জুম চাষ করতো, তখন পাহাড়ে পাহাড়ে থাকতো। যেখানে যখন জুম ফলাত সেখানেই থাকতো। তাদের কেউ মারা গেলে পুড়ে ফেলতো। ছাই এনে দাফন করতো। পরে বাড়িতে নিকট আত্মীয় মামা ভাইয়েরাসহ অন্যদের সাথে নিয়ে শুকুর, মদ, মুরগী দিয়ে খিম্মা বা খাম্মা স্থাপন করতো। শুকুর বা মুরগির রক্ত স্থাপিত খাম্মার উপরে দেয়া হতো, যাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পায়। তিনি বলেন, এ খাম্মায় কাঠ দিয়ে দিতে হয়। তাদের সাংসারেক বিশ্বাস মতে ঐতিহ্যবাহী চু বা মদ আত্মীয় স্বজনরা খাম্মায় মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য ঢেলে দেয়। শ্রাদ্ধ দেয়ার আগে এ নিয়ম পালন করে থাকে। তার মতে, খাম্মার নিয়ম মতো খরচ করতে না পারা, আধুনিকায়ন, শহরমুখী মনোভাব ও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হবার কারণে এখন অনেকটা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে একমাত্র মধুপুরে এখন কিছু কিছু প্রথা টিকে আছে। ভারতে আছে কিছু। আবিমা অঞ্চলে এখনও টিকে আছে সাংসারেক গারো সম্প্রদায়ের খিম্মা স্থাপন। তবে খিম্মার ইতিহাস ও ঐতিহ্য এ প্রজন্মের শিশুদের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে। এখন আর জুম চাষ নেই। তাই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সাংসারেক গারোদের ঐতিহ্যবাহী খিম্মা স্থাপন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর