• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

রাজশাহীর চাষিদের মাথায় হাত

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

মাছ উৎপাদনে কয়েক বছর আগেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) সাম্প্রতিক হিসাব মতে, বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থানীয় দেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ দশমিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। দেশে মোট মাছ উৎপাদনের এক বড় অংশই উৎপাদিত হচ্ছে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। এ সময়ে বাংলাদেশ ৭০ হাজার মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি করেছে বিশ্বের ৫২ দেশে। বিভিন্ন জাতের মাছ রপ্তানি করে বছরে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান সংসদে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে ৫০ হাজার মেট্রিক টন মাছ বেশি উৎপাদন হচ্ছে। তবে দেশের পুকুর-জলাশয়ে মাছের উৎপাদন দিন দিন বাড়লেও হাল আমলে ভারত থেকে মাছ আমদানির ঘটনায় দেশের উত্তরাঞ্চলের মাছচাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের মাছচাষিরা বলছেন, কয়েক বছর বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি হঠাৎ করেই সরকার দেশে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় এমন সব মাছ ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে। এর ফলে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত মাছের চাহিদা একদিকে যেমন কমে গেছে তেমনি মাছের দামও পড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। এতে হাজার হাজার চাষি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পাশাপাশি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাব ফিশারিজ দেশের সর্ববৃহৎ মাছের খামার। এখানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ হয়। এই ফিশারিজের স্বত্বাধিকারী আকবর হোসেন বলেন, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সর্বাধুনিক মৎস্য খামার গড়ে তুলেছি। আমার খামারে বছরে ৪ হাজার মেট্রিক টন রুই, কাতল ও কার্প জাতীয় বিভিন্ন মাছ উৎপাদিত হয়। কয়েক বছর মাছ আমদানি বন্ধ থাকলেও আকস্মিকভাবে রুই-কাতলসহ দেশে চাষযোগ্য বিভিন্ন জাতের মাছ আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। এর ফলে বড় খামারিরা উৎপাদিত মাছ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। সেই সঙ্গে ছোট খামারিরাও ন্যায্য দামে মাছ বিক্রি করতে না পেরে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আকবর হোসেন প্রশ্ন করেন, ডলার সংকটে যেখানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেখানে দেশে বিপুল পরিমাণ মাছ উদ্বৃত্ত থাকার পরও বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ভারত থেকে মাছ আমদানির অনুমতি কেন দেওয়া হয়েছে তা মাছচাষিদের কাছে বোধগম্য নয়। জানা যায়, গত দুই মাসে ভারত থেকে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর ব্যবহার করে আড়াই হাজার টন রুই, কাতল, পাঙাশ ও কার্প মাছ আমদানি হয়েছে। এসব মাছ আনা হয়েছে ভারতের ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। মাছচাষি সাদিকুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের হাজার হাজার পুকুরে মানসম্মত রুই-কাতল-পাঙাশ ও কার্প মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে মাছের কোনো সংকট নেই। কিন্তু কোন কারণে ভারত থেকে মাছ আমদানি করা হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না। এভাবে দেশে বহুল প্রচলিত প্রজাতির মাছ আমদানি হতে থাকলে বাংলাদেশের মৎস্য খাতের বিপুল অর্জন দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাবে। বিপুল আর্থিক লোকসান গুনে হাজার হাজার চাষি অচিরেই পথে বসবে। এদিকে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে মাছ উৎপাদন উপযোগী পুকুর, দিঘি, জলাশয়, প্লাবনভূমি ও বিল রয়েছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৬ হেক্টর। এ পরিমাণ পুকুর জলায় ও প্লাবনভূমিতে বছরে ৮ লাখ ৮৬ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে শুধু রাজশাহী বিভাগে মাছের উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৬১৩ মেট্রিক টন। উত্তরাঞ্চলে মাছের বার্ষিক চাহিদা ৮ লাখ ৯ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন। উত্তরাঞ্চলে ৭৭ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকে। এসব মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে রুই, কাতল ও কার্প মাছ চাষে বিপ্লব ঘটেছে রাজশাহী অঞ্চলে। অধিদপ্তরের সূত্র মতে, দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় মৎস্যজীবীর সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৭২ জন এবং পেশাদার মাছচাষির সংখ্যা ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৩ জন। এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হয় ৭৮ হাজার ২৩৫ পুকুরে। আর জলাশয় রয়েছে ১৭১টি। উত্তরাঞ্চলে মাছের অভয়ারণ্য রয়েছে ১৫৪টি। উত্তরাঞ্চলের চলনবিলসহ ২৫টি বিল বিপুল পরিমাণ দেশি মাছের উৎস। দেশের মধ্যে সর্বাধিক মাছ উৎপাদন হয় রাজশাহী জেলায় ৬ লাখ ৭ হাজার ২৩৩ মেট্রিক টন। এছাড়া রাজশাহী বিভাগের নাটোর, বগুড়া, পাবনা, নওগাঁ জেলায়ও মাছ উৎপাদন হয় চাহিদার তুলনায় বেশি। ভারত থেকে মাছ আমদানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল বলেন, এই বিভাগে চাহিদার তুলনায় অধিক মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এখানে উৎপাদিত মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান হয়ে থাকে। এর ফলে দিন দিন মাছচাষির সংখ্যাও বেড়েছে। এখন মাছ আমদানি হতে থাকলে স্বভাবতই চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি মাছ উৎপাদন হওয়ার পরও ভারত থেকে প্রচলিত জাতের মাছ আমদানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভারত থেকে মাছ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ মাছ আনা হয়েছে সেটা জানি না। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে। মাছ আমদানি অব্যাহত থাকবে নাকি অনুমতি বাতিল করা হবে সে বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে।’ জানা যায়, চলতি মাস থেকে ভারত থেকে মাছ আমদানির অনুমতি রয়েছে। এর আগে রাজশাহী অঞ্চলে মাছের খামারগুলোতে এক মন রুই মাছের পাইকারি দাম ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা। খামার পর্যায়ে কাতল মাছের মন ছিল ১২ হাজার ৮০০ টাকা। অন্যদিকে পাইকারিতে প্রতিকেজি রুই ছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। পাইকারিতে কাতলের কেজি ছিল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। রাজশাহীর মৎস্য খামারি রফিকুল ইসলাম জানান, ভারত থেকে মাছ আমদানি শুরুর পর খামার পর্যায়ে মনপ্রতি রুই মাছের দাম কমে ৬ হাজার ৪০০ থেকে ৭ হাজার টাকায় ঠেকেছে। একই সময়ে মনপ্রতি কাতলের দাম কমে ৭ হাজার ২০০ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা নেমেছে। নাটোরের সিংড়ার মৎস্য খামারি নজরুল ইসলাম বলেন, আমদানির আগে আড়ত পর্যায়ে পাঙাশের মনপ্রতি দাম ছিল ৬ হাজার ৫০০ টাকা। আমদানি শুরুর পর পাঙাশের দাম নেমেছে সাড়ে ৪ হাজার টাকায়। বড় সিলভার কার্প মাছ আগে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে আড়ত পর্যায়ে বিক্রি হলেও এখন ১২০ টাকায় নেমেছে। এছাড়া রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত মৃগেল ও কালিবাউস মাছ সারা দেশে জনপ্রিয় হলেও ভারত থেকে মাছ আমদানি শুরুর পর খামার পর্যায়ে এই দুটি মাছের চাহিদা কমে গেছে। মাছ বিক্রি করতে না পেরে খামারিরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। নওগাঁর মান্দা উপজেলার বাণিজ্যিক মাছচাষি বিমল কুমার সরকার বলেন, দিন দিন মাছের খাদ্যের দাম বাড়ছে অন্যদিকে মাছের দাম কমছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাজশাহী অঞ্চলের হাজার হাজার চাষি মাছ চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। এখন ভারত থেকে মাছ আমদানি হতে থাকলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে চাষিদের মাথায়।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর