• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

দেশের ৪০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে সিংগাইরের গাজর

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

মানিকগঞ্জের সিংগাইরে দিন দিন গাজরের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামই এখন গাজর গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মানুষের কাছে। শুধুমাত্র গাজর চাষ করেই বহু চাষি পাল্টে ফেলেছেন তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা। এ অঞ্চলের গাজর দেশের চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করছে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকার উপরে। মানিকগঞ্জে ভালো মানের হিমাগার স্থাপন ও বিদেশে গাজর রফতানি করা গেলে আরো বেশি মুনাফা করা সম্ভব বলে দাবি চাষিদের। সিংগাইর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, দুই যুগের বেশি সময় ধরে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জয়মন্টপ, আজিমপুর, চর আজিমপুর, কাংশা, কিটিংচর, মিরিরচর, দশানি, নয়াডাঙ্গি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার চাষি গাজর চাষের সঙ্গে জড়িত। চলতি মৌসুমে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৯৫০ হেক্টর জমিতে গাজরের আবাদ হয়েছে। জমি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সব খরচ মিটিয়ে চাষিদের বিঘা প্রতি মুনাফা হচ্ছে অন্তত ৪০ হাজার থেকে ৬০ টাকা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ অঞ্চলের গাজর যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, ভোর থেকেই নারী ও পুরুষরা ক্ষেত থেকে গাজর তোলার কাজ করছেন। পুরুষরা ক্ষেত থেকে উঠিয়ে গাজরগুলোকে একপাশে রাখছেন। অপরদিকে, একদল নারী শ্রমিক গাজরের উপরে থাকা পাতা আলাদা করছেন। গাজরগুলোকে পাটের বস্তায় ভরে সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য গাড়িতে করে খোলায় (গাজর ধোঁয়ার জায়গা) নেয়া হয়। খোলায় নেয়ার পর পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। পরে সেগুলো প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে। সিংগাইর উপজেলার চর আজিমপুর গ্রামের চাষি আবুল হোসেন, ২০ বছর ধরে গাজরের আবাদ করে আসছেন। এ বছর তিনি ১৬ বিঘা জমিতে গাজরের আবাদ করেছেন। সব মিলিয়ে তার সাড়ে ছয় লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এরমধ্যে আট বিঘা জমির গাজর আট লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। বাকি আট বিঘা পরে বিক্রি করবেন। তাতে তার প্রায় আরো ১০ লাখ টাকার গাজর ক্ষেতে রয়েছে। সেইসঙ্গে গাজর ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে ১০ বিঘায় পেঁপের গাছ লাগিয়েছেন। একই গ্রামের সৌদি আবর প্রবাসীর ন্ত্রী সামেলা বেগম জানান, ২০ হাজার টাকায় একবছরের জন্য এক বিঘা জমি ভাড়া নিয়েছেন। সেই ক্ষেতে আরো ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় করে গাজরের আবাদ করে সাড়ে তিন মাসের মাথায় ৯৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। সাড়ে তিন মাসে তার ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। আজিমপুর গ্রামের চাষি মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, এবার জমিতে হালচাষ, বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি নিয়ে বিঘা প্রতি আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। আমি চার বিঘা জমিতে গাজরের আবাদ করেছি। এই পর্যন্ত আড়াই বিঘা জমির গাজর বিক্রি করেছি। আর বাকি গাজর কিছু দিন পর বিক্রি করব। এ পর্যন্ত দুই লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো গাজর বিক্রি করেছি। আরো দুই লাখ টাকা বিক্রির আশা আছে। বিঘা প্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ মণ পর্যন্ত ফলন পেয়েছি। আরেক চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, সিংগাইরের গাজর মান ভালো ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা আছে। অনেক গাজর হয় আমাদের এলাকায়। বর্তমানে প্রতি কেজি গাজর ১০ থেকে ১২ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এই গাজর ঢাকার কারওয়ান বাজার, মিরপুর, নিমশা, শ্যামবাজার, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, সিলেট কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে এই গাজর সংরক্ষণের জন্য আমাদের এলাকায় ভালো মানের কোনো হিমাগার নেই। আর সরকার যদি এই গাজর বিদেশে রফতানি করার জন্য ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে এই চাষের সঙ্গে জড়িত সকলেই উপকার পেত। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি গ্রামের রুবেল হাসান জানান, আমিসহ আরো ২০ জন আমাদের এলাকায় থেকে এবার সিংগাইরে এসেছি গাজর ধোয়ার কাজে। সবমিলে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন মাস এখানে কাজ করি। আমাদের কাজ হচ্ছে ক্ষেত থেকে গাজরগুলো খোলায় (গাজর ধোয়ার জায়গা) এনে পানি দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করে বস্তায় ভরা। প্রতি বস্তা ধুয়ে সেগুলো পুনরায় প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে দিলে বস্তা প্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা করে দেয় মহাজন। এই কাজ করে প্রতিদিন একেকজন ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা পাই। সিংগাইর উপজেলার কামুরা গ্রামের হক আলী জানান, প্রায় দেড়শ বিঘা জায়গার গাজর ক্ষেত কৃষদের কাছ থেকে কিনেছেন। প্রতি বিঘা আকার ও মানভেদে ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন। এসব ক্ষেতের গাজর তিনি এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিক্রি করবেন। সিংগাইর উপজেলার নয়াডাঙ্গি গ্রামের ব্যাপারি মো. সজিব বিশ্বাস বলেন, আমি ২৪ বছর ধরে গাজর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি এ বছর বিভিন্ন চাষির কাছ থেকে ১১০ বিঘা জমির গাজর ক্ষেত কিনেছি। এখন পর্যন্ত ২৩ বিঘা জমির গাজর বিক্রি করেছি। আমি ২০ লাখ টাকার মতো গাজর বিক্রি করেছি। তবে গত বছরের তুলনায় গাজরের দাম এখন কম। প্রতি কেজি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ১২ টাকায়। সিংগাইর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুল বাশার চৌধুরী জানান, সিংগাইরের মাটি ও আবহাওয়া গাজর চাষের জন্য অনেক উপযোগী। সাড়ে তিন থেকে চার মাসে গাজরের ফলন আসে বলে সিংগাইরের বিভিন্ন ইউনিয়নে দিন দিন গাজরের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে সাড়ে ৯শ হেক্টর জমিতে গাজর চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আমরা সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। এ বছর প্রায় ৩৮ হাজার মেট্রিক টন গাজর উৎপাদন হয়েছে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকার। তিনি আরো বলেন, আমরা শুরু থেকে কৃষক ভাইদের পাশে আছি। তাদের নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে আসছি। যেহেতু গাজর চাষের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়িত। তাই এই ফসলের সঙ্গে আমরা তাদেরকে সাথি ফসল হিসেবে পেঁপে চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। দেশের গাজরের চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ এ অঞ্চল থেকে যোগান দেওয়া হচ্ছে। সামনে বছর আমাদের লক্ষ্য আরো বেশি পরিমাণ জমিতে গাজরের আবাদ করা।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর