• বুধবার ০৮ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

  • || ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

থাকছে ১৭ পণ্যের দাম কমানোর কৌশল

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৩১ মে ২০২৩  

অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসন্ন বাজেটে বিশেষ কৌশল গ্রহণ করা হবে। কৃষিপণ্যের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড় দেবে সরকার। এতে করে চাল, ডাল, চিনি, আটা, পেঁয়াজ, ডিম, মুরগি ও মাছের মতো নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজেট ঘোষণার পর ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে। এ লক্ষ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশের বেশি। এই হার কমিয়ে আনা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। 
জানা গেছে, নিত্যপণ্য পেঁয়াজের দাম ও আমদানির লাগাম টানতে এ পণ্যটির উৎপাদন বাড়বে দেশে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে ইতোমধ্যে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও এই ধারা বহাল রাখা হবে। এছাড়া ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কৃষির উপখাত হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাবে পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশুপালন খাত। এ খাতের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেওয়ার মতো কর্মসূচি নেওয়া হবে।

এছাড়া সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বেশিরভাগ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। আয়ের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ-বাজেট খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কি পদক্ষেপ থাকছে। 
এদিকে, আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কৌশল রয়েছে আগামী বাজেটে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে অসঙ্গতি রোধের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বদ্ধপরিকর। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং জাহাজ ভাড়া বাড়ায় আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।


বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তবে আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, আগামী ১ জুন মহান সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত থাকবেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীও খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর ওপর বিশেষ জোর দিয়ে বাজেট প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন। দ্রবম্যূল্য স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকেও অত্যাবশ্যকীয় ১৭ ভোগ্যপণ্য সামগ্রী যেমন চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট , ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ও সকল প্রকার ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর ২ শতাংশ হারে কর্তনে বিধান বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা করা হলে বাজেট ঘোষণার পরও নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করে সংগঠনটি।


জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা, খোলা বাজারে চাল-আটা (ওএমএস) বিক্রি কার্যক্রম জোরদার এবং টিসিবির উপকারভোগী বাড়ানোর মতো কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে প্রস্তাবিত বাজেটে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ থাকছে। একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্যের আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখা এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানিতে প্রযোজ্য শুল্ক-করভার স্থিতাবস্থায় রাখার প্রস্তাব করা হবে।


দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য প্রস্তুতিতে হোয়েট গ্লুটেন ব্যবহৃত হয়। প্রাণীজ শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উক্ত পণ্যের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে আরও কমানো হতে পারে। গোখাদ্য উৎপাদনে চিটা গুড়-এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গোখাদ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে আরও কমিয়ে আনার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। এতে পোল্ট্রি খাতের মুরগি ও গবাদি পশুপালন উৎপাদন বাড়বে। এছাড়া মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উক্ত খাতের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে বিগত সময়ে প্রদত্ত শূন্য শুল্কহার এবং অন্যান্য হারে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। 
এছাড়া গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সারাবছর যাতে পেঁয়াজ উৎপাদন হতে পারে সে লক্ষ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে জোর দেওয়া হবে। পেঁয়াজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, মজুত ও কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হবে নতুন বাজেটে। এছাড়া আলুর বাম্পার উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকগণ যাতে স্বল্প মেয়াদে (৩-৪) মাস সাশ্রয়ী ব্যয়ে তা সংরক্ষণ করতে পারে সে লক্ষ্যে বাস্তুভিটাতেই ক্ষুদ্র আকৃতির প্রাকৃতিক আলু সংরক্ষণাগার স্থাপনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এই প্রকল্পটির কাজ আরও এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেয়া এখন সবচয়ে বেশি জরুরী। তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ধান, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, পোল্ট্রি ও গবাদি পশু উৎপাদন ও লালন-পালনে সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষকদের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইএমএফের ঋণের শর্তে সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়িয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে বিদ্যুতের দাম আরও একবার বাড়ানো হবে বলে আইএমএফকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তারপরও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। তবে বাড়তি বরাদ্দের অর্থ চলতি অর্থবছরের ভর্তুকির বকেয়া পরিশোধে ব্যয় হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকিতে বরাদ্দ রয়েছে একলাখ দুই হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর এটি বেড়ে একলাখ ১০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।

বিপুল ভর্তুকির মধ্যে বকেয়া পরিশোধে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ থাকছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদু্যৃৎ খাতে ভর্তুকিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে নতুন করে আর ভর্তুকি দেওয়া হবে না। সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানোর ফলে আগামী অর্থবছর কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা কমবে বলে হিসাব করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছর এ খাতের ভর্তুকিতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছর কৃষি খাতে ভর্তুকিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে।

এছাড়া সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবি পরিবার কার্ডের আওতায় কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। এ থেকে উপকৃত হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি মানুষ। আগামী অর্থবছরে টিসিবির ভর্তুকি বাড়বে। চলতি অর্থবছরে এখাতে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। আগামী অর্থবছরে এ খাতে ভর্তুকি একহাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতির হ্রাসে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এখন মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আগামী দিনে সরকার কিভাবে তা কমিয়ে ৬ শতাংশে আনবে তা দেখার বিষয়। তিনি আরও বলেন, এখন অবশ্য বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে আসছে। তবে সব কিছুই নির্ভর করবে সরকারের কৌশলের ওপর।

এছাড়া অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন সরকারের শেষ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নতুন করে সাতলাখ ৩৫ হাজার বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া, আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। এতে নতুন অর্থবছর এ খাতে অতিরিক্ত একহাজার ৫২৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। একইসঙ্গে বয়স্কভাতার উপকারভোগীদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর