• বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

  • || ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

ফের ট্রেনে নাশকতা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩  

এবারও ট্রেনের নাশকতায় আগুনে পুড়ে মরল মা-শিশুসহ চারজন। মৃতরা হচ্ছেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার তিন বছরের শিশু সন্তান ইয়াসিন। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অবরোধকারীদের দেওয়া আগুনে ট্রেনের বগিতে আটকে পড়ে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান পপি। অঙ্গার হয়ে যাওয়া মা ও শিশুকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। মর্মান্তিক এই দৃশ্য দেখে হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সসহ আগত দর্শনার্থীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। পরে  চিকিৎসকদের চেষ্টায় মা ও শিশু ইয়াসিনকে আলাদা করা হয়। ঘটনার সংবাদ শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্বজনরা। কান্না ও আর্তনাদে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। 
এদিকে ট্রেনের তিনটি বগিতে নাশকতার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, যারা অবরোধ-হরতাল ডেকেছে, তারাই রেলে আগুন দিয়েছে। 
পিবিআই জানায়, বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ওঠা ৩ ব্যক্তি ট্রেনে বগিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। ট্রেনে অনেক যাত্রীর একই মত। 
অপরদিকে ঘটনাস্থল থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট আলামত সংগ্রহ করেছে। প্রাথমিক তদন্তে বলা হচ্ছে, পেট্রোল ব্যবহার না করলে এত দ্রুত আগুন ছড়ানো সম্ভব নয়।
তেজগাঁও স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার মো. পর্বত আলী জানান, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৪টা ৫০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হয়। তেজগাঁও স্টেশনে এসে পৌঁছায় ৪টা ৫৪ মিনিটে। যেসব ট্রেন তেজগাঁও স্টেশনে থামে না সেগুলোর জন্য আমরা সবুজ বাতি জ্বালিয়ে পার হওয়ার সংকেত দেই। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের জন্যও সবুজ বাতি ধরা হয়েছিল। কিন্তু দেখি যে, ট্রেনের ইঞ্জিনের পেছনের ৫-৭টা বগির পর থেকে ধোঁয়া উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে সবুজ বাতি পরিবর্তন করে লাল বাতি জ্বালিয়ে বিপৎসংকেত দিই। পাশাপাশি স্টেশন রুমে এসে কম্পিউটারের মাধ্যমেও সব সিগন্যাল বিপজ্জনক করে দিই। এতে ট্রেনটি স্টেশনের শেষ প্রান্তে থেমে যায়। তিনি বলেন, ট্রেন থামার পর তাৎক্ষণিক ৯৯৯ এ কল দিয়ে ফায়ার সার্ভিসে জানানো হয়। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়। পরে ৫টা ৮ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রনে চেষ্টা চালায়। পরে ৬টা ১৫ মিনিটে তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।  এরপর ৬টা ২৫ মিনিটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়।
সহকারী স্টেশন মাস্টার মো. পর্বত আলী জানান, আগুনে ট্রেনের ছ, জ, ঝ- এই তিনটি বগি পুড়ে যায়। ভেতর থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে মা ও তার তিন বছরের শিশু সন্তানকে ঝাপটে ধরে ছিল। পরে পলিথিনে মুড়িয়ে মরদেহগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মর্গে পাঠানো হয়। আহত একজনকে একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ট্রেনটি যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে কোনো বিপজ্জনক সংকেত ছাড়াই ছেড়ে এসেছিল, তার মানে এর পরেই আগুন লাগে বলে ধারণা করছেন এই সহকারী স্টেশন মাস্টার। এটি নাশকতা বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে গাজীপুরে একই ঘটনা ঘটেছিল।
তেজগাঁও রেল স্টেশনে চায়ের দোকানদার আবুল খায়ের জানান, তখন ভোর ৫টা। ট্রেনটি যখন তেজগাঁও স্টেশনে আসে, তখন এর মাঝের তিনটি বগি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ট্রেনটি এই স্টেশনে থামার কথা না। তাই ট্রেনটি টেনে যাচ্ছিল। পরে স্টেশন পার হয়ে গিয়ে ট্রেনটি থামে। ট্রেনের শেষ বগি ছিল স্টেশনের দক্ষিণ প্রান্তের শেষে। আর ট্রেনের সম্মুখ ভাগ ছিল তেজগাঁও রেল ক্রসিংয়ে।
ট্রেনে ফেরি করে বাদাম বিক্রেতা আনোয়ার জানান, ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস যখন তেজগাঁও স্টেশনে আসে তখন বাদাম বিক্রিতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিনি জানান, ট্রেনটি যখন তেজগাঁও-বিজয় সরণির ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আসছিল, তখন ট্রেনে মাঝ বরাবর বগি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এ সময় ট্রেনটি যখন স্টেশনের কাছে আসে তখন এক লোক ট্রেন থেকে নিচে লাফ দেয়। তার মাথা ফেটে যায়। কিন্তু লাইন ক্লিয়ার থাকায় ট্রেন চলে যাচ্ছিল। পরে স্টেশনের শেষ মাথায় গিয়ে ট্রেন থামে।
রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, তারা এ ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক নাশকতা’ হিসেবেই সন্দেহ করছেন। তিনি জানান, ট্রেনের দুই বগির সংযোগস্থলে আগুন দেখতে পান রেলওয়ে স্টাফরা। তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশাপাশি দুটি কোচে। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলে অনেকে হুড়াহুড়ি করে নামার চেষ্টা করেন। আবার ভোরের ঘুম ঘুম পরিবেশে অনেকে শুরুতে বুঝতেই পারেননি কী ঘটতে যাচ্ছে। ওই ঘটনায় ট্রেন থেকে নামতে গিয়েও কয়েকজন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মাথায় আঘাত পেয়ে নুরুল হক ওরফে আব্দুল কাদের (৫৩) নামে এক যাত্রীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত আব্দুল কাদির নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তার বাড়ি। তিনি  ঢাকায় হামীম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিবহন শাখায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
এ ঘটনায় রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. দিদার আহমদ সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতা বড় কথা নয়, এই নৃশংস ঘটনা যারা ঘটায় তারা মনুষ্যত্বহীন। বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করে। দেশের সম্পদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কর্মকাণ্ড যারা করে, তারা মানুষ না। তারা বাংলাদেশের মানুষ কিনা, তারা বাংলাদেশকে পছন্দ কর কিনা এ বিষয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। অতীতে এ রকম যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার মতোই এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে ক্রিমিনালদের উপস্থাপন করা হবে।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন যাত্রীদের বরাত দিয়ে জানান, ট্রেনটি নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসছিল। ভোরের দিকে বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে ট্রেনটি খিলক্ষেতে এলে যাত্রীরা বগিগুলোয় আগুন দেখতে পান। তাঁরা চিৎকার করতে শুরু করেন। এরপর চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান। তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মাজহারুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক। পুড়ে যাওয়া ট্রেনটিকে সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার জানান, সকাল পৌনে সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। সকাল আটটার দিকে তেজগাঁও স্টেশনে বকুল আক্তার নামে এক নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। 
গত ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বনখরিয়া এলাকায় রেললাইনে নাশকতা চালায় অবরোধকারীরা। এতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় আসলাম মিয়া (৪৫) নামে একজন নিহত হন। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। এ ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়াসহ চার আসামির প্রত্যেকের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অন্য তিন আসামি হচ্ছে, সাইদুল ইসলাম, জুলকারনাইন হৃদয় ও সোহেল রানা।
শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে পুড়ে অঙ্গার পপি ॥ সন্তানকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল নাদিয়া আক্তার পপি (৩৫)। ছেলে ইয়াসিনও মাকে জাপটে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছিল। সর্বনাশা আগুনে দুজনকেই মৃত্যুর আলিঙ্গন করতে হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোরের দিকে চলন্ত ট্রেনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তখন অনেকে ঘুমিয়েছিলেন। পপির কোলে ঘুমিয়ে ছিলেন তিন বছরের শিশু ইয়াসিন। আগুন দেখে শিশু ইয়াসিনকে ঝাপটে ধরে নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আগুন দেখে যাত্রী বোঝাই ট্রেনের বগি থেকে হুড়াহুড়ি করে নামছিলেন। হুড়াহুড়ির ভেতর দিয়ে পপির ছোট ভাই হাবিবুর রহমান (১৮) ও তার ভগিনা ফাহিম (৯) নিয়ে নিরাপদে ট্রেন থেমে পড়েন।

নামতে গিয়ে হাবিবুর রহমান আহত হয়। কিন্তু হুড়োহুড়ি মধ্যে নামতে পারেননি নাদিরা আক্তার পপি ও তার কোলের শিশু ইয়াসিন। তখনই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। বাঁচার জন্য মা পপি যেভাবে ছেলে ইয়াসিন ঝাপটে ধরেছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্গে বাইরে লাশবাহী সাদা ব্যাগেও একইভাবে রাখা ছিল মা-ছেলের পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশ। পরে চিকিৎসকের চেষ্টা মায়ের বুক থেকে আলাদা করা হয় ছেলে ইয়াসিনের লাশ। 

পুলিশ জানায়, সোমবার রাত ১২টার দিকে নেত্রকোনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে পপি তার ছোট ভাই হাবিবুর রহমান, দুই ছেলেকে নিয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী হিসেবে ঢাকায় আসছিলেন। মঙ্গলবার ভোরে বিএনপির হরতাল শুরুর আগে আগে ট্রেনটি যখন ঢাকায় ঢুকছিল। তখনই ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীবেশী নাশকতাকারীরা আগুন দেয় ওই ট্রেনের বগিতেতে। ভয়াবহ ওই ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়েছে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগি। পপি ও তার ছেলে ইয়াসিন ছাড়াও অজ্ঞাত দুই ব্যক্তির প্রাণ যায়। আগুনে তারা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। তাদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন পপির স্বামীর মিজানুর রহমানসহ স্বজনরা। স্বজনের কান্না ও আহাজারিতে হাসপাতালের মর্গের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। পপির স্বামী মিজানুর রহমান কাওরানবাজারে ব্যবসা করেন। তেজগাঁও তেজকুনিপাড়ায় সপরিবারের থাকতেন। 
মিজানুরের ভাই দেলোয়ার হোসেন টিটু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, পপি তার দুই সন্তান ও ছোট ভাই হাবিবুর রহমানকে নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। ট্রেনে আগুন লাগার পর হাবিবুরের সঙ্গে পপির বড় ছেলে বের হয়ে আসতে পারলেও পপি ও তার ছোট ছেলে বের হতে পারেনি। আমরা তার লাশ পেয়েছি মায়ের কোলে, মাকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায় ছিল।
হাসপাতালে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ওই সন্তানটি ভয় পেয়ে হয়ত তার মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আর তার মা ও হয়ত সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুজনকেই মৃত্যু আলিঙ্গন করতে হয়েছে। ওই অবস্থাতেই পাওয়া গেছে তাদের লাশ। 
আগুনসন্ত্রাসীদের বিচার হবে তো ॥ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গে গিয়ে দেখা গেছে, ট্রলির ওপর রাখা ছিল পুড়ে অঙ্গার মা-ছেলে ও অজ্ঞাত দুই ব্যক্তির লাশ। মর্গে বাইরে দাঁড়িয়ে স্ত্রী পপি ও ছোট ছেলে ইয়াসিনের লাশবাহী সাদা কালো ব্যাগের দিকে বারবার বিলাপ করছিলেন মিজানুর রহমান। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। আমার ভেতরে কী চলছে, এটা বোঝাতে পারব না। আমার তো সবই শেষ হয়ে গেল। কী অপরাধে আমার সব শেষ হয়ে গেল জানি না। আগুনসন্ত্রাসীদের কি বিচার হবে! এমন প্রশ্ন রেখে তিনি জানান, আমি কারও কাছে বিচার চাইব না। এখন একটাই চাওয়া, আমার স্ত্রী-সন্তানকে যেন আর কাটাছেঁড়া করা না হয়। শুধু অক্ষত লাশ ফেরত চাই। রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন মিজানুর।

স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায়। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী নাদিরা আক্তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার বড়ুয়া গ্রামের যান। সেখান থেকেই সোমবার রাত ১২টার দিকে নেত্রকোনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। সঙ্গে ছিলেন শ্যালক কলেজপড়ুয়া হাবিবুর রহমান। ট্রেনে আগুন লাগার পর ফাহিমকে নিয়ে হাবিবুর ট্রেন থেকে নেমে যান। তবে নাদিরা ও ইয়াছিন আটকা পড়ে। তিনি জানান, সোমবার রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ওঠার পর নাদিরার সঙ্গে কথা হয়েছিল। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার দিকে নাদিরার ভাই হাবিবুর ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। বাসা থেকে দ্রুত তেজগাঁও রেলস্টেশনে ছুটে আসি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন চারটি লাশ নামায়,  দেখি আমার স্ত্রী-সন্তান পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।’
ট্রেনের বগি থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত নূরুল হক। তিনি জানান, তার বগি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ভোরের দিকে বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে বনানীর কাছাকাছি আসার পর ওই বগিতে আগুন লাগে। তখন রেলের নিরাপত্তাকর্মীদের পোশাক পরা কয়েকজন অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই অন্য বগিতে আগুন লেগে যায়। ১০ সেকেন্ডের ভেতরে চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন ট্রেন অনেক গতিতে  চলছিল। দরজা খুলে গেটের কাছে দাঁড়াই। তখনো ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস নিতে পারিনি।’ পরে ট্রেন থেকে লাফ দেন তিনি।
বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে গেলে বাচ্চা ও ভাবি বেঁচে যেতেন ॥ সোমবার রাত ১২টার দিকে নেত্রকোনা থেকে রাতে ঢাকার উদ্দেশে ট্রেনে ওঠেন একই পরিবারের নয় সদস্য। তাদের মধ্যে পাঁচজন বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে যান। বাকি চারজনের নামার কথা ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। তবে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অবরোধকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান ভাবি নাদিয়া আক্তার পপি (৩৫) ও ভাতিজা ইয়াসিন (৩) আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালের সামনে নিহত পপির দেবর দেলোয়ার হোসেন টিটু কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, সবাই যদি বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যেত তা হলে ভাতিজা ও ভাবি বেঁচে যেতেন।
এক বকুল আক্তারের কথা ॥ তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি বগিতে আগুনে কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীর স্বজনরা। এদের মধ্যে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী বকুল আক্তার খাতুন (৬০)। ছেলেকে খুঁজছেন তিনি। সকালে বিলাপ করছিলেন বকুল আক্তার। তিনি জানান, আমি আমার পোলারে পাইতাসি না। আল্লাহই জানে আমার পোলায় বাঁইচা আছে নাকি মইরা গেছে। আমি জানি না। ট্রেনের থোন নামার পর আর তারে দেখতাছি না। ধোঁয়ায় চোখে কিছু দেখতেছিলাম না। নাতিনরে কোলে নিয়া ট্রেন থেকে নাইমা আইসি। 
বকুল আক্তার জানান, রাতে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ট্রেনে ওঠেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে খোকন মিয়া (২২) ও নাতনি। গ্রামের বাড়ি মধ্যনগর থেকে যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জ। ভোরের দিকে পথেই ট্রেনে আগুনের ঘটনা ঘটে।
যাত্রী বকুল আক্তার জানান, মঙ্গলবার ভোরে তারা ট্রেনের আগুন টের পান। চারদিক ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। যে কারণে তারা কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। খোকন তাকে বলেছিলেন নাতনিকে কোলে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়তে। এ সময় তিনি তাদের ব্যাগ খুঁজছিলেন। খোকন ও তার স্ত্রী নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টসে চাকরি করেন।
তিনি জানান, ট্রেনের থোন নামার পর আমি আমার পোলারে আর খুইঁজা পাইতাসি না। আমার পোলায় বাঁইচা আছে নাকি মইরা গেছে জানি না। আমারে একটা সাহায্য করেন, আমি বাড়ি যাইমু।
ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হবে ॥ ব্যবসায়িক কাজে নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ঢাকায় রওনা হয়েছিলেন রশিদ ঢালী (৬০)। তবে সকাল থেকেই তার ফোন বন্ধ পাচ্ছেন স্বজনরা। রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে ট্রেনে অবরোধকারীদের দেওয়া আগুনে ৪ জনের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন রশিদ ঢালীর স্বজনরা। সেখানেই পরনের পোশাক দেখে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেন রশিদ ঢালীর মরদেহ। তবে পুলিশ বলছে, চেহারা দেখে না চেনা যাওয়ায় ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে। মঙ্গলবার দুপুরে স্বজনরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে এসে মৃতদেহ শনাক্ত করেন রশিদ ঢালীর ভাতিজা বেলাল আহমেদ।
তিনি জানান, পরনের সোয়েটার, জুতা দেখে তার চাচার মৃতদেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন তিনি। তবে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় তার চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। তিনি জানান, তাদের বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার উত্তর নাগড়া গ্রামে। এলাকাতেই পোশাকের ব্যবসা করতেন। মালামাল কেনার জন্য নিয়মিতই তিনি নেত্রকোনা থেকে ট্রেনযোগে ঢাকায় আসতেন। সোমবার রাত ১২টার দিকে তিনি মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে রওনা দেন। সকালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তারা খবর পান, ঢাকায় ট্রেনে আগুনে ৪ জন মারা গেছেন।

গ্রাম থেকে স্বজনদের মাধ্যমে সেই খবর পেয়ে ঢাকায় থাকা বেলাল চাচা রশিদ ঢালীকে খুঁজতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে তার পরনের পোশাক দেখে চিনতে পারেন। এ ছাড়া তার ক্লিন শেভ করা ও শুধু গোফ ছিল। তাও মিল পাওয়া গেছে মরদেহে। স্বজনরা জানান, তার রশিদের স্ত্রীর নাম পেয়ারা বেগম। দুই ছেলে এক মেয়ের জনক তিনি। রশিদের বাবার নাম মৃত বসির ঢালী।
ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সেতাফুর রহমান জানান, অজ্ঞাতনামা হিসেবে থাকা মরদেহের মধ্যে একজনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। বিকালে তার স্বজনরা পড়নের কাপড় ও জুতা দেখে তাকে শনাক্ত করেন। তবে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ প্রোফাইলিং মাধ্যমে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে। এসআই সেতাফুর রহমান জানান, নিহত শিশু ইয়াসিন ও তার মা নাদিরা আক্তার পপির মরদেহ বিনা ময়নাতদন্তে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তিন ব্যক্তি ট্রেনের বগিতে আগুন দিয়েছে ॥ তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুনের ঘটনাকে নাশকতামূলক কাজ বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জানান, প্রাথমিক তদন্ত প্রমাণ করে যে একটি নাশকতামূলক কাজ।  
তিনি জানান, আমরা সন্দেহ করছি যে তিন ব্যক্তি বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনের তিনটি বগিতে উঠেছিলেন তারা পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন। তদন্ত সাপেক্ষে এ বিষয়ে আমরা স্পষ্ট বলতে পারব। তিনি জানান, তারা এখন বিমানবন্দর স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করছেন এবং কারা সেখান থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন এবং তেজগাঁও স্টেশন থেকে কারা নেমেছেন তা জানার চেষ্টা করছেন। 
কমলাপুরে ঘটনাস্থল থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট আলামত সংগ্রহ করেছে। প্রাথমিক তদন্তে বলা হচ্ছে, পেট্রোল ব্যবহার না করলে এত দ্রুত আগুন ছড়ানো সম্ভব নয়।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি ॥ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগিতে নাশকতার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। মন্ত্রী বলেন, তেজগাঁওয়ে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রেলের ডিস্ট্রিক্ট ট্রান্সপোর্ট অফিসারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছে রেলওয়ে।
পুড়ে মারা গেলেন বিএনপি নেতা ॥ বিএনপির হরতাল চলাকালে নাশকতার আগুনে মারা গেছেন বিএনপিরই এক নেতা। মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনে মারা যাওয়া ওই বিএনপি নেতার নাম আব্দুর রশিদ ঢালী (৬৫)। তিনি নেত্রকোনা শহরের নাগড়া এলাকার বাসিন্দা। জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক এসএম মনিরুজ্জামান দুদু এ বিএনপি নেতার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 
দুদু জানান, আব্দুর রশিদ ঢালী নেত্রকোনা পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি। এর আগে তিনি যুবদলের নেতা ছিলেন। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. আনোয়ারুল হক এবং সদস্য সচিব ড. রফিকুল ইসলাম হিলালীও তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। শোক বার্তায় তারা উল্লেখ করেন, ‘আব্দুর রশিদ ঢালী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন।’
জানা গেছে, আব্দুর রশিদ ঢালী শহরের বড়বাজার এলাকায় গার্মেন্টস কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মঙ্গলবার ভোরে নেত্রকোনা স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে তেজগাঁও এলাকায় এ নাশকতার ঘটনা ঘটে। এতে চারজন মারা যান। এদের মধ্যে ঢালী ছাড়াও আরও দুজন রয়েছেন নেত্রকোনার। তারা হলেন, সদর উপজেলার বরুনা গ্রামের নাদিরা আক্তার ও তার তিন বছর বয়সী ছেলে ইয়াসিন। অপর একজনের পরিচয় জানা যায়নি।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর