• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

বই আলোচনা : ‘জীবন-কথা মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার’

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৪ মে ২০২৩  

জামালপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার (১৯০৫-১৯৮৫) একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর দীর্ঘ ত্রিকালদর্শী জীবন ও কর্ম নিয়ে ছত্রিশ বছর পর বিশিষ্ট গবেষক, প্রাবন্ধিক শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান “জীবন-কথা মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার” নামে একটি তথ্যবহুল ও প্রামাণিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। 

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে এ অঞ্চলের বর্তমান প্রজন্মের কাছে মির্জা সাহেব এখন প্রায় বিস্মৃত। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না; বিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত তিনি এই অঞ্চলের নানাবিধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের বীজ বপন করেন। যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এই হিসেবে তিনি জামালপুর জেলার ইতিহাসের অংশ। 
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার ছিলেন একাধারে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী, সমাজসেবী ও সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ। জামালপুর জেলার উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে তাঁর নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি জামালপুর-শেরপুরবাসীর নিকট মির্জা সাহেব নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ব্রিটিশ আমলের বিশ শতকের চল্লিশের দশকে তদানীন্তন শেরপুর থানার ও বাংলাদেশ আমলের সত্তরের দশকে জামালপুরের দীর্ঘদিন প্রথম শ্রেণির ক্ষমতাপ্রাপ্ত অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। 
বিশ শতকের অবিভক্ত ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।  জামালপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘তওফিক’ পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রক ছিলেন তিনিই। একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট প্রতিভা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে 'আসামের জঙ্গলে' একটি ক্ল্যাসিকতুল্য ভ্রমণকাহিনি। এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাসহ অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন তিনি। জামালপুর শহরে তিনি ১৯৫৯ সালে প্রথম বিদ্যুতায়নে পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেন। তদানীন্তন জামালপুর মহকুমার ঐতিহ্যবাহী জামালপুর পৌরসভার ১৯৬০-১৯৬৫ মেয়াদে ভাইস-চেয়ারম্যান (বর্তমানে মেয়র) ছিলেন তিনি। এ অঞ্চলে সমবায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর  ভূমিকা অগ্রণী। 

‘জীবন-কথা মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার’ গ্রন্থখানা বিজয় প্রকাশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন আনিছুর রহমান লয়েট, পৃষ্ঠা ১৪৪, মূল্য : ৩০০ টাকা। গ্রন্থটির সূচিতে ছোট বড় ২৭টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত। বিভক্ত অংশগুলো হলো জীবন-কথা, সমকালীন পরিবেশ-পটভূমি, জন্ম ও বংশ পরিচয়, জীবন-দর্শন, পরিবার-পরিচিতি, শৈশবকাল, বাল্যজীবন, শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিক কর্মকাÐ, দেশবন্ধুর সাহচার্য, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মূল্যায়ন, কর্মজীবন, সাময়িকপত্র সম্পাদনা, সামাজিক সংগঠনে সংশ্লিষ্টতা, সমাজসেবা, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ও বেঞ্চকোর্টের সদস্যরূপে, সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা, সমকালে কতিপয় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য, কতিপয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সমকালীন প্রতিক্রিয়া, স্মৃতিরক্ষা ও স্বীকৃতি, জীবনপঞ্জি, রচনা-নিদর্শন, চিঠিপত্র, শেষজীবন ও মৃত্যু, মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখির তথ্য ও আলোকচিত্র।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের ওপর প্রণীত গ্রন্থটির রচনার তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণা  বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন মর্মে লেখকের কথা অংশে গ্রন্থকার জানিয়েছেন। এ গ্রন্থ পাঠ করে একজন মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারকে অনুধাবন করা যায়। বইয়ে তাঁর জন্ম থেকে মৃত্য পর্যন্ত  প্রায় সব উল্লেখযোগ্য ঘটনাই লেখক নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন। তাঁর জন্ম, পরিচয়, লেখাপড়া, রাজনীতি প্রভৃতি সবকিছুই আলোচিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর লেখালেখিসহ খুঁটিনাটি প্রায় সবই তুলে এনেছেন সুন্দরভাবে। গ্রন্থটির বিভিন্ন অংশে সমকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে। এটি এ গ্রন্থের একটি বিশিষ্ট দিক। এই বইতে তাঁর লেখা ‘আসামের জঙ্গলে’ ভ্রমণকাহিনির সংকলিত সংক্ষেপিত অংশ চয়ন করার হয়েছে। ইহা একটি ক্লাসিকতুল্য ভ্রমণকাহিনি।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার রাজনীতিবিদ হিসেবেই সুপরিচিত। কিন্তু এই বই পড়লে পাওয়া যায় রাজনীতি সত্তার বাইরে তাঁর আরেক বিস্তৃত লেখালেখির জীবন। তাঁর শৈল্পিক মনন, সাংস্কৃতিক জীবন, শিল্প ও সংস্কৃতি, খেলাধুলা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন Ñ সবই আলোকপাত করা হয়েছে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার সর্ম্পকে আগ্রহীরা যে কেউই তাঁর হস্তাক্ষর লেখা ছড়া পড়ে প্রীত হবেন। তাঁর অনেকগুলো দুর্লভ ছবি, চিঠিপত্র, মূল্যবান স্মারক বইটির তাৎপর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের জীবন-কর্ম অবদান পর্যবেক্ষণ এবং উপলব্ধিকরণে বইটি থেকে পাঠক সমাজ অনেক অনুসন্ধানী ও চমকপদ তথ্য জানতে পারবেন।
জীবনী রচনা লিখতে গেলে কালের ধুলোতে কিছু কথা বাদ পড়ে যায় কিংবা বর্ণনার ছেদ পড়ে। এ বইটির ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। গ্রন্থটির রচনার নির্দশন অংশে মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের সাহিত্যকর্ম আরও বেশি চয়ন করা গেলে ভালো হতো। তবে বইটির বর্ণনার বিন্যাসের পূর্বাপর, সরল উপস্থাপনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চমৎকার। এ বই নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক স্মারকের দাবি রাখে।
জামালপুরের বিস্মৃত ব্যাক্তি মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের ওপর এই প্রকাশনা নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্মকে আলোক-উদ্ভাসিত করবে। তাঁর জীবন ও কর্ম উত্তরপ্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হতে পারে আরও বহুকাল।

লেখক : 
মোহাম্মদ নাজমুল হোসাইন,
স্নাতকোত্তর (সমাজবিজ্ঞান) শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী, 
ঢাকা কলেজ

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর