• বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

  • || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

সাড়ে ১২ হাজার টাকা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০২৩  

গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চার হাজার পাঁচশ’ টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন নির্ধারিত মজুরি কার্যকর করা হবে। আর জানুয়ারির শুরুতে নববর্ষের প্রথম সপ্তায় নতুন কাঠামো অনুযায়ী মজুরি পাবেন শ্রমিকরা। ঘোষণা অনুযায়ী, গত পাঁচ বছর পর শ্রমিকদের মজুরি বাড়ল ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। বেতন বাড়ানোর দাবিতে গাজীপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যেই এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করেন। তার আগে এদিন সকালে শ্রম ভবনে  পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় এই মজুরি চূড়ান্ত করা হয়। পোশাক শ্রমিকদের নতুন ন্যূনতম মজুরি গ্রহণযোগ্য বলে জানিয়েছেন শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি। 
সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সচিবালয়ে তার দপ্তরে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী মালিক ও শ্রমিক পক্ষকে নিয়ে সর্বনিম্ন মজুরি  ঘোষণা করা হলো। দীর্ঘ দিন শ্রমজীবী মানুষ আন্দোলন করে আসছে মজুরি বৃদ্ধির জন্য। মালিকদের বলব ফ্যাক্টরি খুলে দিবেন, শ্রমিকদের বলব কাজে যোগদান করতে। আর ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বহাল আছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্যা, বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।

সভার পর পোশাক শ্রমিকদের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের বাস্তবতা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে শ্রমিকরা বোর্ডের সিদ্ধান্ত  মেনে নেবেন। তবে সভায় পোশাক শ্রমিকদের রেশন দেওয়ায় বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে সরকার তাদের জন্য ফ্যামিলি কার্ড চালু করার পরিকল্পনা করছে বলে জানান মন্নুজান সুফিয়ান। এ ছাড়া আন্দোলনরত  পোশাক কর্মীদের কাজে ফেরার আহ্বানও জানান তিনি।
এদিকে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির এই সময়ে ন্যূনতম মজুরি বাড়ায় এ খাতের শ্রমিকদের জন্য এটি ভালো ও খুশির খবর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা সংকটের প্রভাব এখন দেশের অর্থনীতিতে। মহামারি করোনার সময় অনেক বেসরকারি খাত চাপের মুখে পড়ে কর্মকর্তাদের বেতন কমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীতে অবস্থার পরিবর্তন ও করোনা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ফের ঘুরে দাঁড়ায় দেশের অর্থনীতি। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের কারণে আবার অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি এ খাতকে আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করবে বলে মনে করা হচ্ছে। শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে আবার তার কর্মস্থলে ফিরে যাবেন।

ঘুরবে পোশাক খাতের চাকা।  সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২১ নভেম্বর মজুরির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে সরকার। শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোতে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ টাকা  মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৭ হাজার ৮৭৫ টাকা। উল্লেখ্য, এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পাঁচ বছরের জন্য পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করে সরকার। সে অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি ঘোষণা করার দাবি ছিল শ্রমিকদের।

এদিকে পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সম্প্রতি জানান, পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন ২৩ হাজার টাকা মজুরির দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এই বেতনের মধ্যে ৬৫ শতাংশ মূল বেতন, বার্ষিক ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, ৭টি গ্রেডের পরিবর্তে ৫টি গ্রেড করার দাবি তারা তুলে ধরেছেন। এই দাবির সঙ্গে অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনগুলোও ঐকমত্য জানিয়েছে। 
উল্লেখ্য, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে গত এপ্রিলে ন্যূনতম মজুর বোর্ড গঠন করে সরকার। গত ২২ অক্টোবর এই বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন। আর মালিক পক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। তবে মালিক পক্ষের প্রস্তাবের খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করে পোশাক শ্রমিকরা। পরে তা নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় শ্রমিকরা ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। সংঘাতে এবং এক কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় প্রাণ যায় অন্তত দুইজনের।

পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যায়ক্রমে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে, বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকরা মঙ্গলবারও গাজীপুরে দুই বাসে আগুন দিয়ে  বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। তবে নতুন মজুরি ঘোষণার বিষয়টি শ্রমিকরা বেশ ভালোভাবে মেনে নেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা চলছে। অনেক দেশ অর্থ বাঁচাতে সাশ্রয়ীমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ফলে পোশাক রপ্তানি কোনো মাসে বাড়লে আবার অন্য মাসে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে। তবে শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদেরও বুঝতে হবে আগে শিল্প বাঁচাতে হবে।

শিল্প বাঁচলে শ্রমিকরা বাঁচবেন। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএম’র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, শ্রমিকরাই এ শিল্পের প্রাণ। এ কারণে এমনভাবে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে মালিক ও শ্রমিক সবাই ভালো থাকেন। তবে শ্রমিকরা যে ২০ হাজার টাকার ওপরে মজুরি দাবি করছে এ বিষয়টি বাস্তব সম্মত নয় বলে মনে করেন শ্রমিক নেতা মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে বেতন বাড়বে। 
মজুরি বোর্ডের বৈঠক ॥  মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্যার সভাপতিত্বে মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে শুরু হওয়া বোর্ডের সভায় অংশগ্রহণ করেন মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি, মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি মকসুদ বেলাল সিদ্দিকী, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি সুলতান আহম্মদ এবং নিরপেক্ষ প্রতিনিধি কামাল উদ্দিন। ২০১৩ সালে পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করেছিল  ন্যূনতম মজুরি বোর্ড। এর পর ২০১৮ সালে নিম্নতম মজুরি তার চেয়ে প্রায় ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন নিম্নতম মজুরি দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকা।

তবে মজুরি বোর্ড বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা দেয়নি। সূত্র জানায়, শ্রমিদের ন্যূনতম বেতন কত হবে সে বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব আসলেও বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী আরেক দফা বৈঠক করে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। সেই বৈঠকে নতুন মজুরি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়। এদিকে, বাংলাদেশের তৈরি  পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি পুননির্ধারণের জন্য ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ  থেকে। তবে শ্রমিকদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে সেই সময়ের আগে নতুন মজুরির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।  এদিকে, ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে পোশাক শ্রমিকদের নতুন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণকে গ্রহণযোগ্য বলে জানিয়েছেন শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি।

মজুরি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে  তিনি বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে এ শিল্প খাতে কাজ করছি। আমাদের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রমিকরা যাতে কর্মচ্যুত না হন, তাদের যেন বাড়ি ফিরে যেতে না হয়, তাদের অবস্থা আমাদের দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুসারে আমরা মনে করি এটা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে  বেঁচে থাকার জন্য মোটামুটি একটা অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটা গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, আমরা খুশির অবস্থায় নেই। রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি মিলিয়ে আমরা এটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমরা খুশিও না, বেজারও না।

এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকলেও আমরা আপাতত এটা মেনে নিয়েছি। এদিকে, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দিয়েছে মজুরি বোর্ড। তবে এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রমিক নেতাদের একাংশ ও শ্রমিকরা। মঙ্গলবার  বিকেলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক  ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দাবি আদায়ে তারা নতুন কর্মসূচি  দেবেন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর