• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

দরপত্র কিনেছে বিশ্বসেরা ৭ প্রতিষ্ঠান

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৯ মে ২০২৪  

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র চলতি বছরের শুরুতেই আহ্বান করা হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ‘আকর্ষণীয়’ মডেল পিএসসির আলোকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আহ্বান করা দরপত্রে ইতোমধ্যে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাড়া পাচ্ছে সরকার, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) আয়োজিত প্রমোশনাল সেমিনারে।

বিশ্বের অন্তত ১৫টি বড় কোম্পানি অংশ নেয় এই সেমিনারে। যার মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কিনেছে দরপত্র। এর মধ্যে রয়েছে শেভরন, এক্সন মোবিল, টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জের মতো বাঘা বাঘা কোম্পানি। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে দরপত্র প্রক্রিয়া। সব মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগবে এই অনুসন্ধান কার্যক্রমের সফলতা আসতে। তবে অনুসন্ধান কার্যক্রমে সবার আগে দেশের স্বার্থই বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। 
বঙ্গোপসাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গত ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। সমুদ্রের ২৪টি ব্লক ইজারা দিতে আহ্বান করা হয় এ দরপত্র। আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাখিল করতে হবে দর প্রস্তাব। সেগুলোর মূল্যায়ন শেষে আগামী বছরের মাঝামাঝিতে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
এর আগেই বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘অফশোর বিডিং রাউন্ড- ২০২৪’ উপলক্ষে একটি প্রচারমূলক  সেমিনারের আয়োজন করে পেট্রোবাংলা।

সেখানে বিশ্বের অন্তত ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৪০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। সেমিনারে জানানো হয়, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দরপত্রের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘ রোড-শো’ করা হচ্ছে, যার ফলে বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। সমুদ্রের ২৪টি ব্লকে জ্বালানি অনুসন্ধানে বিশ্বের অন্তত ৫৫টি কোম্পানিকে দরপত্রে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিল পেট্রোবাংলা।

আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে (আইওসি) দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী করে তুলতে করা হচ্ছে নিয়মিত রোড শো। যার বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানিতে। শুধু এই সেমিনারে অংশ নিয়েছে পেট্রোনাস, এক্সন মবিল, শেভরন, ইনপেক্স করপোরেশন, জগমেক জাপান, ক্রিস এনার্জি, ওএনজিসি, চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল করপোরেশন ও ইতালিয়ান কোম্পানি ইএনআই।

অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি টিজিএস-স্লামবার্জার তাদের মাল্টি ক্লায়েন্টে সার্ভের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে তেল-গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে নিযুক্ত মর্কিন কোম্পানি শেভরনের পক্ষে থেকেও এই অঞ্চলে কূপ খনন ও ব্যবসা পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়। 
এগুলোর মধ্যে সাতটি কোম্পানি সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অংশ নিতে দরপত্র কিনেছে বলে সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আজকের সেমিনারেও ১৫টির বেশি আন্তর্জাতিক কোম্পানি অংশ নিয়েছে।

দরপত্রে দেশের স্বার্থের পাশাপাশি বিনিয়োগকারী কোম্পানির স্বার্থও দেখা হয়েছে। ফলে আমরা দরপত্র নিয়ে বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে আমরা ইতোমধ্যেই ওএনজিসির সঙ্গে চুক্তি করেছি। বাকিগুলোও হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোম্পানিগুলো এখানে আসুক। যারা ইতোপূর্বে খুব সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করেছে। আমরা উন্মুক্ত দর পদ্ধতিতে কাজটি তাদের কাউকে দিতে চাচ্ছি। ২০১৬ সালে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

সমুদ্রে ডাটা প্রসেস করতে গিয়ে তিনটি বছর লেগে গেছে। পরবর্তীতে করোনার কারণে আরও দুটি বছর পার হয়ে গেছে। বর্তমান জরিপ প্রতিবেদনের ওপর অনেক দেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমেরিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ আগ্রহ দেখিয়ে গেছে। অনেকে ডেটা কিনছেন। প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাংলাদেশের প্রথম অফশোর বিডিংটা যেন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিডিং প্রসেস শেষ হবে।

পরবর্তীতে প্রস্তাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা ঠিক করব। তবে সব মিলিয়ে এখান থেকে গ্যাস বা তেল তুলতে ৭ থেকে ৮ বছর লাগবে বলে মনে করি। আমাদের কর্মকর্তারা খুবই পরিশ্রম করে একটি আন্তর্জাতিক মানের মডেল পিএসসি তৈরি করেছে। কনসালট্যান্ট কোম্পানি উড ম্যাকেনজি এখানে ভালো ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের পিএসসিগুলো বিশ্লেষণ করে সেখান থেকে সহযোগিতা নিয়েছি। একটি ভালো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই বিডিং প্রসেসটা শেষ করতে পারব বলে আশাবাদী।
গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে স্থলভাগের সঙ্গে জলভাগেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে অনুমোদন হয় পিএসএসির। একই সময়ে দেশের জলভাগে অনুসন্ধান কার্যক্রমে আগ্রহী তাদের সঙ্গে সমঝোতা করার পাশাপাশি দেশের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি কোন কোম্পানি প্রাধান্য পেতে পারে তা খুঁজে বের করার কাজও শুরু করে জ্বালানি বিভাগ।

জানুয়ারিতে শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সমুদ্রে অনুসন্ধানের আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে এই কোম্পানিটিরও একাধিক ব্লক অনুসন্ধানের জন্য অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বুধবারের সেমিনারে অংশ নিয়ে শেভরন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরিক এম ওয়াকার বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে শেভরন সব সময়ই কাজ করতে আগ্রহী। সমুদ্রে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও আমরা আগ্রহী। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সম্ভাবনা অপার। সেই সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা কাম্য।

এছাড়াও বিশ্বের অন্যতম বড় কোম্পানি হিসেবে পরিচিত এক্সন মবিলের একটি প্রতিনিধি দলও তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে চারটির বেশি ব্লক এক কোম্পানিকে দিতে চায় না সরকার। এক্ষত্রে ভাগ হওয়া সমুদ্র অঞ্চলের ২৪ ব্লকে কয়েকটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হবে জানিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধানের আওতায় কোনো কোম্পানিকে সমুদ্রে অনুসন্ধানের কাজ দেওয়া হবে না।

পিএসসি তৈরিতে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে দিয়ে পিএসসির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষে উন্মুক্ত হয়েছে দরপত্র। দরপত্রের কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য ছয় মাস সময় দেওয়া হবে। নভেম্বর বা ডিসেম্বরে পিএসসি (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) চূড়ান্ত করতে চাই। তবে এটি নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির জন্য না রেখে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে দর আহ্বান করব। যেটা দেশের স্বার্থের জন্য বেশি ভালো হবে, তাদেরই কাজ দেওয়া হবে।
আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল ও শেভরনের মতো কোম্পানি যারা আগে আগ্রহ দেখিয়েছে, তাদের বিষয়ে কী ভাবা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রতিযোগিতামূলক দরের দিকে যাচ্ছি। এখানে যে কোম্পানির প্রস্তাব সুবিধাজনক হবে এবং যাদের যোগ্য মনে করা হবে, তারাই কাজ পাবে। সবার আগে দেশের স্বার্থ।
দেশের উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদ মেটাতে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে প্রণীত খসড়া ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্টাক (পিএসসি) ২০২৩’ অনুমোদন দেওয়া হয়। সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর এক দশক ধরে ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছিল বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ।

চারটি বিদেশী কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি ছেড়ে গেছে বঙ্গোপসাগর। গত ১০ বছরে নতুন করে কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এতদিন নতুন করে দরপত্র আহ্বানের উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির (পিএসসি) চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন হয় গত বছরের ৭ জুলাই।
কাক্সিক্ষত মুনাফা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও বাজার চাহিদা বিবেচনায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুন্ধানে বিনিয়োগ সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে আগ্রহী ঠিকাদারদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী। প্রচারমূলক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর হচ্ছে এমন একটি জলভাগ, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ এখনো উত্তোলন করা হয়নি।

বাংলাদেশ, ভারতসহ এই অঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানির একটা বড় বাজার রয়েছে। কেবল বাংলাদেশেরই আগামী দিনে প্রচুর তেল-গ্যাস প্রয়োজন। বিশ্বের যুদ্ধ-বিগ্রহপূর্ণ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এটা হচ্ছে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ। এসব কারণে এটা হবে বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ‘অপরচুনিটি ফর ইনভেস্টমেন্ট’। বাংলায় এটাকে বলা হয় মণিকাঞ্চানযোগ।
তিনি বলেন, এবারের পিএসসিতে দাম নির্ধারণের সূত্রটি ব্রেন্ট অয়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, আগে সালফারের সঙ্গে ছিল। সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নতুন করে আর ফ্যাক্টর যুক্ত করেছি। এর অর্থ হচ্ছে, লাভ যত বেশি হবে, সেখান থেকে আনুপাতিক হারে দুই পক্ষই ভাগ পাবে। আরও অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে করা হয়েছে। এটা দিয়ে কোম্পানিগুলো বুঝতে পারবেন যে কোথায় কতখানি সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এটা খুবই সময়োপযোগী হয়েছে এবং যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। 
এক্ষেত্রে মিয়ানমার পরিস্থিতি কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ চাপ আছে, আন্তর্জাতিক চাপ আছে। আর মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। সুতরাং তারা বাস্তবতা চিন্তা করে সবাই মিলে একটা শান্ত বঙ্গোপসাগর গড়ে তুলতে পারব।
জানা যায়, গ্যাস ও খনিজ প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনায় দেশের স্থলভাগকে ২২টি এবং সমুদ্রভাগকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এই ২৬টির মধ্যে ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রে অবস্থিত। বাকি ১৫টি গভীর সমুদ্রে। এখন ২৪টি ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বর্তমানে শুধু অগভীর অংশের দুটি ব্লকে (এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯) অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড। চলতি বছরে তাদের জরিপ কাজের ফল পাওয়ার কথা রয়েছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর