• বুধবার ০৮ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

  • || ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

রেললাইন কেটে নাশকতা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩  

‘বিকট শব্দ! সিট থেকে পড়ে গড়াতে থাকি। একটু পরে কয়েকটি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায় ট্রেনটি। অন্ধকার বগিতে চিৎকার ও আতঙ্ক। মোবাইলের লাইট জ্বেলে কোনোমতে জানালা দিয়ে বের হয়ে দেখি রেললাইন বেঁকে গিয়ে ট্রেনটির কয়েকটি বগি কাত হয়ে পড়ে আছে। যাত্রীরাও বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছেন। 
কোনোমতে জীবন নিয়ে বের হয়েছি।’ এভাবে কথাগুলো বললেন গাজীপুরের শ্রীপুরের দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের যাত্রী ইকবাল হোসেন।
মঙ্গলবার ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের গাজীপুরের শ্রীপুরের বনখড়িয়া গ্রামের ভাওয়াল স্টেশনের কাছে লাইন কেটে ফেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। গ্যাসকাটার দিয়ে রেললাইনটি কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এতে ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটের চলাচলকারী আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সেপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনায় আসলাম হোসেন (৩৫) নামের একজন যাত্রী নিহত ও ট্রেনের চালকসহ ১৩ জন যাত্রী আহত হয়েছে। 
দুর্ঘটনার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়েন ট্রেনযাত্রীরা। এতে ভোগান্তিতে পড়েন এসব ট্রেনে থাকা শত শত যাত্রী। দুর্ঘটনার পরে উদ্ধারকারী ট্রেন ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। ঘটনার পর পরই সেখানে উপস্থিত হয় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিবি, আনসার সদস্য, জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে বিপুল পরিমাণ উৎসুক জনতা ভিড় করে। উদ্ধারকাজে বিপদ এড়াতে ঘটনাস্থলের বিশাল এলাকা ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।  

দুর্ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয় তিনটি তদন্ত কমিটি। যুগ্ম সচিব শাহ ইমাম আলী রেজাকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রেলপথটি মেরামত ও উদ্ধারকাজ চলছিল বলে স্থানীয় সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অবরোধকারীদের নাশকতার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই রেলপথ দিয়ে ৪৫ মিনিট ব্যবধানে অপর একটি ট্রেন যাতায়াত করেছে। ৪৫ মিনিট পর মোহনগঞ্জ এক্সেপ্রেস ট্রেনটি লাইচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা গ্যাসকাটার দিয়ে রেললাইনটি কেটে ফেলেছে। হরতাল-অবরোধে ট্রেন পরিচালনা আগেই ট্রলি ট্রেন পরিচালনা করা হয়। তা প্রায় ২ ঘণ্টা ব্যবধান থাকে। রেলপথের পাশে ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে এই নাশকতা করা হয়েছে। হরতাল-অবরোধে রেলপথের নাশকতা প্রতিরোধে আনসার, আরএনবি ও রেল পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
গাজীপুর থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে গাজীপুরের ভাওয়াল স্টেশনের পার্শ্ববর্তী বনখড়িয়া এলাকার চিলাই ব্রিজের পাশে এই রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মো. আসলাম হোসেন (৩৫) নামের একজন যাত্রী নিহত হয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা রৌহাসাইটা এলাকার মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি মুরগির ব্যবসা করতেন। 
ট্রেন চালকসহ ১৩ জন যাত্রী আহত ॥ ট্রেন চালকসহ ১৩ জন যাত্রী আহত হয়েছে। এ বিষয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত ১৩ জনকে এ হাসপাতালে আনা হয়েছে। তারা হলেন ট্রেন চালক মো. ইমদাদুল হক (৫৭) ও সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া (৩২), ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রফিকুল মোল্লা (৩৫), একই উপজেলার জামিলা (৩৫), কুমিল্লার জসিম উদ্দিনের মেয়ে সুরভী সাহা (১৮), গৌতম সাহার স্ত্রী রুপালি সাহা (৪০), মনির উদ্দিনের ছেলে বেলাল উদ্দিন ( ৪০),  জসিম উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা (৪২), নিজাম উদ্দিনের ছেলে জলিল (৩৮), লালু মিয়ার ছেলে সুমন (২৫), কুদ্দুসের ছেলে সবুজ (৩২), ইসমাইল হোসেনের ছেলে এমদাদ (২৫), নেত্রকোনার গনু  মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম মোল্লা (৪০)। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ট্রেন চালক ইমদাদুল হক, সহকারী চালক মো. সবুজ মিয়া ও রুপালি সাহাকে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অপর আহত রফিকুল ইসলাম মোল্লা, জামিলা ও সুরভী সাহাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন।
আতঙ্কিত যাত্রীদের চিৎকার ॥ দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের যাত্রী হাবিবা খাতুন জানান, দুই শিশুসহ তারা মাঝামাঝি একটি বগিতে মোট চারজন ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে তাদের বগিটি পাশের গভীর জমিতে পড়ে যায়। বিকট শব্দ হওয়ার পর পরই আমার সন্তানকে পাচ্ছিলাম না। বগি অন্ধকার হয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করছিল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সন্তানদের খুঁজে পেয়ে ওপরের দিকের জানালা দিয়ে বের হই। এতে আমাদের অনেকেই শরীরে আঘাত পেয়েছে।
দুর্ঘটনাস্থলের পাশের বনখড়িয়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘুমাইয়া ছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। পরে ঘর থাইকা বাইর হইয়া শুনি কান্নাকাটির আওয়াজ। কাছে গিয়া দেখি রেললাইনটি ল-ভ- হইয়া কয়েকটা বগি এলোমেলো পইড়া আছে। যাত্রীদের চিৎকারে তহন আশপাশের শতশত লোকজন ছুটে আসে। যে যার মতো উদ্ধার করে তাদের হাসপাতালে পাঠায়।’
স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাতের কোন এক সময় দুষ্কৃতিকারীরা গ্যাস কাটার দিয়ে গাজীপুরের ভাওয়াল স্টেশন ও রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকার চিলাই নদীর ওপর নির্মিত চিলাই ব্রিজের প্রায় একশ’ ফুট উত্তর পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের পূর্ব পাশের প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখে। এলাকাটি দুর্গম ও নির্জন। রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি মঙ্গলবার দিনগত ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ব্রিজে ওঠার আগেই বিকট শব্দে ইঞ্জিনসহ ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে রেললাইনের পাশে।

তবে ইঞ্জিনটি বগি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাইনের পাশের জমিতে কাত হয়ে পড়ে। বিকট শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এসে ভিড় জমায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় হতাহতদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠানো হয়। এই ঘটনায় রেললাইনের অন্তত ৬০০ ফুট দুমড়ে মুচড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রেললাইনের পাশ থেকে একটি ও ঘটনাস্থলের পাশের জঙ্গল থেকে আরও একটি গ্যাসের সিলিন্ডার (বোতল) উদ্ধার করে।

প্রতিটি সিলিন্ডার ১২ কেজি ওজনের। এদিকে সকাল ৯টার দিকে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে। এ সময় শ্রীপুর থেকে একটি ইঞ্জিন এনে দুর্ঘটনাকবলিত বগিগুলো বাদে অবশিষ্ট বগিগুলো টেনে শ্রীপুর স্টেশনে নিয়ে যায়। দুর্ঘটনাকবলিত বগিগুলো উদ্ধার শেষে বিকেলে রেললাইন মেরামতের কাজ করে। 
রেল কর্মকর্তা মোশারেফ হোসেন ভুইয়া বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেনগুলো ভৈরব-কিশোরগঞ্জ হয়ে চলছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বলাকা কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ কমিউটার ও মহুয়া কমিউটার ট্রেনের যাত্রা কর্তৃপক্ষের আবেদনে বাতিল করা হয়েছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম ও গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী  সফিকুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। 
অবরোধকারীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ॥ দুর্ঘটনা বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘প্রায় একশ’ স্লিপার এবং তিনশ’ ফুট রেল লাইন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোচগুলো রেললাইনের পাশে রাখা হবে। পরে রেললাইন মেরামত করে ক্রমান্বয়ে কোচগুলো সরিয়ে ফেলা হবে। আমাদের ট্রেন চলাচল বন্ধ নেই। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ-জামালপুর যেসব ট্রেন যায়, সেগুলো বিকল্প পথে ভৈরব হয়ে চলাচল করছে। নিহতের পরিবারকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে। তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ঘটনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা একটি নাশকতা।’
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘শীতের রাত ও কুয়াশা থাকায় ট্রেনের গতি কম ছিল। তাই হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। একজন যাত্রী মৃত্যু বরণ করেছেন। আহত ৭ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। দুটি গ্যাস সিডিন্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। একটি সিলিন্ডার যে জায়গায় প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে রাখা হয়েছে তার পাশেই ছিল। অপর সিলিন্ডারটি কিছু দূরে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এটা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। দুষ্কৃতকারীরা গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে প্রায় ২০ ফুটের মতো লাইন কেটে রেখে দিয়েছিল। যার কারণে মোহনগঞ্জ একপ্রেসের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ইতোমধ্যে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’
গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী সফিকুল আলম বলেন, এটা দুর্ঘটনা নয়, নাশকতামূলক কাজ। যারা দুষ্কৃতকারী, যারা অবরোধকে সমর্থন দিচ্ছেÑ তারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমি মনে করি দুষ্কৃতকারীরা যে কাজটি করেছে তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। দেশের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। আমাদের টিম ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যেই এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব। 
তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন ॥ আমাদের শ্রীপুর সংবাদদাতা জানান, গাজীপুরের বনখড়িয়ায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে একটি রেলওয়ে মন্ত্রণালয়, রেলওয়ে ঢাকা ডিভিশনের পক্ষ থেকে একটি টেকনিক্যাল তদন্ত কমিটি এবং অপরটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি ঘটনাটি নাশকতা। তার পরও সঠিক কারণ অনুসন্ধানে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সৌমিক শাওন কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটিসহ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন বিভাগীয় পরিবহন প্রকৌশলী, বিভাগীয় যাত্রী প্রকৌশলী, বিভাগীয় চিকিৎসক প্রমুখ। এদিকে গাজীপুরের জেলা প্রশাসন থেকে পাঁচজন সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। 
শোকের ছায়া আসলাম পরিবারে ॥ গফরগাঁও থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, গফরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সবজি কিনে ঢাকায় বিক্রি করতেন আসলাম মিয়া। প্রায় প্রতি দিনই ট্রেনে যাতায়াত করতেন। বুধবার যে শেষ যাত্রা তা জানা ছিল না সবজি বিক্রেতা মো. আসলাম মিয়ার (৩০)। ট্রেন দুর্ঘটনায় আসলাম মিয়া নিহত হওয়ায় স্বজনদের আহাজারিতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে।
স্থানীয়রা জানান, আসলাম মিয়া শাক-সবজি, মুরগি, ডিম, কবুতরের বাচ্চাসহ ১৫ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনে চড়ে গফরগাঁও থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেক্স ট্রেনে যাত্রা করেন। তিনি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা গ্রামের মৃত মোছলেম উদ্দিনের ছেলে। আসলামের মৃত্যুর সংবাদে স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে যায়। স্ত্রী ফাতেমা খাতুন বলেন, ২ ছেলে শুভ (১১), আবু রায়হান (২) ও ১ মেয়ে আরিফা (৮)। এই সন্তানদের কি হবে। আহাজারি করে তিনি বলেন, আমার জামাই নির্দোষ গো আমার জামাইয়ে তো কোনো দোষ করছে না তা হলে আজ কেন আমাদের এই অবস্থা এবং দ্রুত লাশ হস্তান্তরের দাবি জানাই। 
গুরুতর আহত ট্রেন চালক ॥ গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের আহত চালক ও তার সহকারীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন মো. ইমদাদুল হক (৫৭) ও মো. সবুজ মিয়া (৩০)। তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা ফারুক জানান, গাজীপুরের ভাওয়াল রাজেন্দ্রপুর এলাকায় দুষ্কৃতকারীরা ট্রেন লাইন কেটে ফেলায় এ ঘটনা ঘটে। আহত ইমদাদুল হক ও সবুজ মিয়াকে উদ্ধার করে প্রথমে গাজীপুর হাসপাতালে পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে আনা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তারা। তিনি জানান, ট্রেন চালক ইমদাদুল হকের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার সিলিমপুর গ্রামে। বাবার নাম ইসমাইল হোসেন। সহকারী চালক সবুজ মিয়ার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানার মাওহা গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল কুদ্দুস।
দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বগি-ইঞ্জিন, মেরামত শেষে রেল চলাচলের উপযোগী ॥ গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশন ও রাজেন্দ্রপুর রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী বন খড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে ফেললে ইঞ্জিনসহ সাত বগি লাইনচ্যুত হয়। ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথের ৬০০ ফুট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরে রেল কর্তৃপক্ষ রেললাইন মেরামত করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলে রেল চলাচল চালু করা হলেও দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বগি ও ইঞ্জিন রেল সড়কের দুপাশে পড়ে রয়েছে। 
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান জানান, প্রায় ১৪ ঘণ্টা শেষে রাত পৌনে ৮টার দিকে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়ক ট্রেন চলাচলের জন্য উপযোগী হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলো ও মালামাল সরিয়ে নেওয়ার পর ওই রুটে ট্রেন চলাচল শুরু করবে।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় শুধু রেললাইনের বগি-ইঞ্জিনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ইঞ্জিন-বগির পাশাপাশি ৬শ ফুট রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০০টি স্লিপার পুরোই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তিনশ ফুট রেললাইনে নতুন করে পাত বসানো হচ্ছে। যার ইতোমধ্যে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রেল লাইনের মেরামত শেষে রিলিফ ট্রেন চালানো হয়েছে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত লাইন মেরামত শেষে পুরোপুরি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। লাইনচ্যুত বগিগুলো নিরাপদ দূরত্বে রেল লাইনের পাশে সরিয়ে রাখা হবে আর লাইনচ্যুত ইঞ্জিন উদ্ধার করা হবে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর