• শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

  • || ১৯ মুহররম ১৪৪৬

উপজেলা পরিষদ: নির্দলীয় নির্বাচন !

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২০ জানুয়ারি ২০২৪  

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এবার উপজেলা নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়ার দাবি তুলেছে বিভিন্ন মহল। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এমন দাবি জানিয়েছে কোনো কোনো মহল। দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হলে বিএনপিও অংশ নিতে পারে। তাই এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছোটখাটো কিছু ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে নতুন উদ্যমে সুষ্ঠুভাবে উপজেলা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০১৫ সালের নভেম্বরে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। তবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিসহ আরও কিছু দল এ বিধানের বিরোধিতা করে আগের মতো দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়। আইন করার পর থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকে অংশ নেয়। তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নানামুখী সমস্যা দেখা দেয়। যে কারণে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই দলের নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে দলীয় প্রতীক ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তোলে। এ দাবি দিন দিন আরও জোরদার হচ্ছে। সূত্র মতে, অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যৌথসভায় দলের নেতারা দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচনের দাবি জানান। এ সময় তারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে কি কি সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় তাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। আপাতত দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন করা না গেলেও যাতে নৌকা প্রতীক কাউকে না দিয়ে নির্বাচন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় সে দাবিও জানান তারা। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীও এ দাবিটি বিবেচনা করে দেখবেন বলে জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে শুক্রবার বলেন, উপজেলা পরিষদসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখলে নির্বাচন আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক ও পক্ষপাতহীন হবে। দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হলে অধিক জনপ্রিয় প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেবেন। প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকলে যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয় এবং দলের বাইরেও ভালো প্রার্থী বিজয়ী হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আমরা সে বার্তা পেয়েছি। আওয়ামী লীগের আরেকটি সূত্র জানায়, এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার কথা ভাবছে দলের নেতারা। তৃণমূলের রাজনীতিতে বিভাজন ঠেকাতে এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় দলীয় প্রার্থী না দেওয়ার বিষয়ে তারা ভাবছেন। কারণ, অতীতে দেখা গেছে একজনকে প্রতীক দিলে আরেকজন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাতে দলীয় শৃঙ্খলা যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনই তৃণমূলে বিভেদ-বিভাজনও সৃষ্টি হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচনের বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে দ্রুত স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করে আসন্ন উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীক ছাড়া করা সম্ভব হবে। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, যদি দ্রুত আইন সংশোধন করে এবার দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা যায় তাহলেও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত নিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে কাউকে দলীয় প্রতীক না দিলেই হবে। কোনো দল থেকে যারা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন তাদের দলীয় প্রতীক না দিলে তারা নির্বাচন কমিশন থেকে লটারিতে প্রাপ্ত প্রতীকে নির্বাচন করবেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হলে চেয়ারম্যান পদে যে প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক পান তিনি বিভিন্ন কারণে কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে যান। কখনো কখনো দেখা যায় অধিকতর যোগ্য প্রার্থীও দলীয় প্রতীক না পাওয়ার কারণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। কারণ, ভোটের ফলাফলে দলীয় প্রতীকের প্রভাব পড়ে। আবার কোনো দলের একাধিক প্রার্থী হলে সেক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকের বাইরে কেউ কেউ প্রচারে অংশ নিতে ও ভোট দিতে বিব্রতবোধ করেন। আর দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিপরীতে বিরোধী দলের অনেকেই প্রার্থী হতে চান না। আবার দল করেন না কিন্তু অধিকতর যোগ্য প্রার্থী থাকলে তারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে চান না। উল্লেখ্য, ৭ জানুয়ারি সারাদেশে একযোগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে এখন বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। প্রথমেই আসন্ন রোজার আগেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আগের মতো এবারও সারাদেশের সকল উপজেলার নির্বাচন হবে কয়েকটি ধাপে। পাঁচ থেকে ছয় ধাপে নির্বাচন হতে পারে। এ মাসেই প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। বর্তমানে দেশে উপজেলা রয়েছে ৪৯৫টি। আইন অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের মেয়াদ হচ্ছে প্রথম সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। আর নির্বাচন করতে হয় মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে। ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেহেতু পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাই শপথও হয়েছে পাঁচ বা তার বেশি ধাপে। যে কারণে উপজেলাগুলোর মেয়াদও ধাপে ধাপে শেষ হবে। আর সে অনুযায়ী ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় গণনা করা হবে। নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, রোজার আগেই শুরু হবে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপের নির্বাচন হবে রোজার আগে। অন্যান্য ধাপের ভোট হবে ঈদের পর। তবে কোন কোন উপজেলার মেয়াদ আগে শেষ হচ্ছে সেই তালিকা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রস্তুত আছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে চলতি মাসের শেষের দিকে। কমিশন অনুমোদন দিলে রোজা শুরু হওয়ার আগেই প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১০ মার্চ বা তার একদিন আগে-পরে রোজা শুরু হতে পারে। তার আগেই হতে পারে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন। ৪৯৫টির মধ্যে ৪৮৫ উপজেলা এখন নির্বাচনযোগ্য। বিভিন্ন কারণে, বাকি ১০টি উপজেলার নির্বাচন পরে করা হবে। ইসি থেকে জানা যায়, দেশে ২০১৮ সালের মার্চে ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে অনুযায়ী সব উপজেলাই নির্বাচনযোগ্য। তবে সামনে এসএসসি পরীক্ষা এবং রোজার বিষয়টি বিবেচনায় আসবে। কারণ, দেশে রোজার মধ্যে নির্বাচন না হওয়ার প্র্যাকটিস আছে, সেজন্য রোজার আগে প্রথম ধাপের নির্বাচন শুরু হতে পারে। রোজার জন্য বিরতি দিয়ে পরবর্তী ধাপগুলোর নির্বাচন ঈদের পর হবে। ইসি সূত্র জানায়, মার্চের প্রথম সপ্তায় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের ভোট নেওয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে গতবার কোন উপজেলায় কবে ভোট হয়েছে, কবে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এসব বিষয়ে তথ্য দিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন। এ তথ্য হাতে পাওয়ার পর প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। ইসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ১৯৮৫ সালে দেশে প্রথমবারের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ১৯৯০ সালে দ্বিতীয়বার ও ২০০৯ সালে তৃতীয়বার, ২০১৪ সালে চতুর্থবার এবং ২০১৯ সালে পঞ্চমবার উপজেলা পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে ১৪টি উপজেলায় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়। ২০১৯ সালে দেশে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় ৪৮৮টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ৪৫৫টির নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়। বাকি উপজেলাগুলোর নির্বাচন পরে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালের ১০ মার্চ প্রথম ধাপে ৮২টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ১২৩টি, ২৪ মার্চ তৃতীয় ধাপে ১২২টি, ৩১ মার্চ চতুর্থ ধাপে ১০৬টি এবং ১৮ জুন পঞ্চম ধাপে ২২টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে জুন-জুলাই মাসে সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হয় ৪৮৬ উপজেলার নির্বাচন। ওই সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে ভারপ্রাপ্ত সিইসির দায়িত্ব পালন করেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক। পাঁচ দফায় অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হয়। উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ১৭(১) (গ) ধারা অনুসারে উপজেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে, ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ থেকে পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বিজয়ীদের শপথ ২০১৯ সালের মার্চে হয়েছে। অন্য ধাপেরগুলো শপথ পরবর্তীতে ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে এপ্রিল ও মে মাসে। তাই ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ক্ষণ গণনা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই শুরু করেছে ইসি।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর