• শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

  • || ১৯ মুহররম ১৪৪৬

উত্তরের যোগাযোগে গতি আনবে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২৪  

উত্তরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। বর্ধিত সময়ের এক বছর আগেই আসছে ডিসেম্বরে এ সেতু দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের আশা করছে রেল বিভাগ। 

সেতুটি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের রেল যোগাযোগে যে দুর্গতি আছে, এ সেতু চালু হলে তা কেটে যাবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পথ হিসেবে ভারতের সঙ্গে রেল সংযোগেও এ সেতু মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় নীলফামারীর চিলাহাটী অংশে ব্রডগেজ পথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও চলছে। অন্যপাশে ভারতের ফুলবাড়ী অংশে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করছে দেশটির রেল বিভাগ।

সরেজমিন রেল সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে দিন-রাত চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। প্রকল্পে রয়েছেন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ৫০ পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যান বসিয়ে সেতুর ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার স্থাপনা এখন দৃশ্যমান। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এরই মধ্যে ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সেতুর ওপর ডুয়েলগেজ রেলপথ বসানোর কাজ। সেতুর দু’পাশে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে রেলস্টেশন। দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মের এ স্টেশন দুটি তৈরিতে আধুনিক নির্মাণশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া সেতু ঘিরে পূর্ব ও পশ্চিম পাশের অতিরিক্ত রেলপথ বসানো কাজও শেষ করা হয়েছে। স্টেশন ইয়ার্ড আধুনিকায়ন কাজের জন্য স্টেশন বিল্ডিং, প্ল্যাটফর্ম বাড়ানোসহ ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণকাজ শেষের দিকে। এ জন্য বিদ্যমান রেললাইন পুনর্নির্মাণে চারটি লাইন ক্রমান্বয়ে সরিয়ে নতুন ছয়টি রেলপথ স্থাপন করা হয়েছে।

সূত্র বলছে, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত রেল সেতুতে পূর্ণ গতিতে ট্রেন চলতে না পারায় এবং সিঙ্গেল-ট্র্যাক রেলপথ হওয়ায় যাতায়াতে বেশি সময় লাগে। এতে ট্রেনগুলো শিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এ ছাড়া ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার গতিতে চলা একটি ট্রেন সেতুটির পূর্ব পাশের স্টেশন থেকে পশ্চিম পাশের স্টেশনে পৌঁছাতে অনেক বেশি সময় নেয়। ওজন সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে পুরোনো সেতুতে ভারী পণ্যবাহী ট্রেন চলতে পারে না।

আর বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুতে দ্রুতগতির কারণে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছার সময় গড়ে দুই ঘণ্টা কমে যাবে। পাশাপাশি পাশের দেশ থেকে রেলপথে পণ্য পরিবহনের সুবিধা বাড়বে। অভ্যন্তরীণ পথে সহজে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনও করা যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক), বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক), সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন (সাসেক), অন্যান্য আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথ নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হবে।

২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর সেতুটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সেতুটির ভিত্তি স্থাপন করা হয়। প্রকল্পের ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রতিষ্ঠান জাইকা ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা দেওয়ার কথা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তী সংশোধিত প্রকল্পে সময়সীমা দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। একই সঙ্গে প্রকল্প খরচ ৭ হাজার ৪৭ কোটি বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকায় নেওয়া হয়। এ খরচের ৭২ শতাংশ ঋণ সহায়তা দিচ্ছে জাইকা। বাংলাদেশ রেলওয়ে আলাদা দুটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে একটি ডব্লিউডি-১ পাকেজে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প পূর্বাঞ্চলের সিভিল ওয়ার্ক এবং প্যাকেজ ডব্লিউডি-২ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ পশ্চিমাঞ্চলের সিভিল ওয়ার্ক। সেতুটির পূর্ব অংশ নির্মাণ করছে ওবায়শি করপোরেশন, টিওএ করপোরেশন এবং জেএফই। এ অংশের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৬ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। আর আইএইচআই ও এসএমসিসির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে পশ্চিম অংশ। এ অংশে ব্যয় হচ্ছে ৬ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। সেতুটি নির্মাণে জাপান, ভিয়েতনাম, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী ও প্রকৌশলী কাজ করছেন।

কর্তৃপক্ষ জানায়, মূল সেতুর উভয় প্রান্তে মোট প্রায় শূন্য দশমিক শূন্য ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (রাস্তা), প্রায় ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট (বেড়িবাঁধ) এবং লুপ (চক্র), সাইডিংসহ মোট প্রায় ৩০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এ সেতুতে ৫০টি পিলারের ওপর কংক্রিটের রেলপথ বসানো হচ্ছে। সেখানে কোনো স্লিপার থাকছে না। এ ছাড়া ওয়েদারিং স্টিল (যা মরিচ ও ক্ষয় প্রতিরোধী) এবং ড্রিলমে প্রিভেনশন গার্ড (দুর্ঘটনা প্রতিরোধী) এ রকম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

১৯৯৮ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেল যোগাযোগ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে বর্তমানে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে প্রতিদিন ৩৮টি ট্রেন পারাপার হয়। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি প্রায়ই শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। নতুন সেতু দিয়ে প্রতিদিন ৮৮টি ট্রেন ব্রডগেজ লাইনে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার এবং মিটারগেজ লাইনে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে। 

বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট গ্লোবাল লিমিটেডের প্রকৌশলী রবিউল আলম বলেন, সেতুর ওপরে রেলপথ স্থাপন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু অংশে লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই পুরো অংশের কাজ শেষ হবে। 
বঙ্গবন্ধু রেল সেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতুতে লাইন স্থাপনের কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। সেতুতে গার্ড রেলের বদলে ডিরেলমেন্ট প্রিভেনশন গার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে রক্ষণাবেক্ষণ-সংক্রান্ত কাজ সহজ হবে।

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের কাজ গতিহীন 
এ প্রকল্প অনুমোদন হয় প্রায় ছয় বছর আগে। প্রথম দফায় বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের জুনে। তবে এর মধ্যে মূল কাজ শুরু করা যায়নি। এরপর সময় বাড়ানো হয় এক বছর। এখন সেই প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হতে চলেছে। এখনও ভূমি অধিগ্রহণই শেষ হয়নি।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকার সঙ্গে বগুড়ার দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ ৮৫ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথের প্রকল্প খরচ ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ভারত। বাকি ২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে এই অঞ্চলের ট্রেনগুলো ঢাকায় যেতে সান্তাহার, নাটোর ও পাবনার  ঈশ্বরদী হয়ে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ ঘুরে চলাচল করছে। 

বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ দিয়েছি। নির্দিষ্ট এলাকায় যাতে নতুন করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা না হয়, সে ব্যাপারেও নজরদারি করা হচ্ছে। কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেলেও আশা করছি, জমি অধিগ্রহণের পরবর্তী কাজ দ্রুত সময়ে শেষ করা যাবে।’

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর