• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

যে বাঙালিকে কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মান জানায় জাপানিরা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৩০ এপ্রিল ২০২৩  

জাপানের প্রয়াত সম্রাট হিরোহিতো বলেছিলেন, ‘যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।’

এটি ছিল একজন বাঙালির প্রতি জাপানের কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকার। এ বাঙালির জন্ম বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে। তিনি হলেন প্রাজ্ঞ আইনজীবী ও শিক্ষাবিদ ড. রাধাবিনোদ পাল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত টোকিও ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসাবে তার ভিন্নমতের রায় বিশ্ব সমাজকে নাড়া দিয়েছিল। আর এ রায়ের সুবাধে তিনি জাপানের জনগণের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন অসামান্য শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা।

রাজধানী টোকিও শহরের চিয়োদা এলাকায় ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধ। প্রায় ২৫ লাখ মানুষের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে এ স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছিল। এসব মানুষ জাপানের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে অথবা যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন। এখানে একটি মাত্র স্মৃতিস্তম্ভ ব্যতিক্রম, যার স্মরণে এটি তৈরি তিনি এ ধরনের কোনো যুদ্ধ বা সহিংসতায় নিহত হননি।

ড. রাধাবিনোদ পাল হলেন সেই ব্যক্তি। যাকে সম্মান জানাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শান্তিকামী মানুষ ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধে আসেন। এই সাহসী বাঙালিকে জাপানে জাতীয় বীরের সম্মান দেওয়া হয়।

মৃত্যুর এক বছর আগে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো তাকে প্রদান করে গেছেন দেশটির সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘ফার্স্ট অর্ডার অব সেক্রেড ট্রেজার (ঋরৎংঃ ঙৎফবৎ ড়ভ ঝধপৎবফ ঞৎবধংঁৎব)।’ রাধাবিনোদ পালের ভাস্কর্য সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে জাপানের কিয়োতো শহরে। শুধু ভাস্কর্যই নয় তার নামে তৈরি হয়েছে জাদুঘর। রাজধানী টোকিওতে আছে প্রশস্ত রাজপথ। ২০০৭ সালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে ভারত সফরে গিয়ে রাধাবিনোদ পালের ছেলে প্রশান্ত পালের সঙ্গে দেখা করেন।

শুক্রবার দুপুরে টোকিওর চিয়োদা এলাকার ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধে ড. রাধাবিনোদ পালের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে কথা হয় ভারতের ঝাঁসি থেকে আসা চিকিৎসক সঞ্জয় চুবার সঙ্গে। তিনি একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে কয়েক দিন আগে টোকিও আসেন। ব্যস্ততা সত্ত্বেও এই চিকিৎসক স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাধাবিনোদ পালের স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে এসেছেন ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধে। সঞ্জয় চুবা বলেন, রাধাবিনোদ পাল সম্পর্কে আমি জানি। এমন একজন মানুষ যে দেশে জন্মেছেন সে দেশের মানুষ খুবই গর্বিত।

ভারতের এই চিকিৎসকের মতোই দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে আসা প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম ভুট্টো, লুলু জামালী, আবু সাইদ ও রফিকুল ইসলামকে দেখতে পাওয়া গেল ড. রাধাবিনোদ পালের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে। এদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, আমরা গর্বিত যে তিনি (ড. রাধাবিনোদ পাল) বাংলাদেশে জন্মেছেন। টোকিও এসে একজনের কাছ থেকে শুনে তারা এখানে এসেছেন বলে জানালেন প্রবাসী এই বাংলাদেশি।

বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের জন্ম ১৮৮৬ সালে ৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের শালিমপুর গ্রামে এবং মৃত্যু কলকাতায় ১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারি। এই সাহসী বাঙালির নৈতিকতার বিজয় নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক ডকুমেন্টারি। ‘টোকিও ট্রায়াল’ নামের ওয়েব সিরিজে রাধাবিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় করেন মুম্বাইয়ের প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খান।

শৈশবে রাধাবিনোদ পালের পিতা সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধারণ করেন। এ কারণে তাকে একটা বড় সময় নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে হয়। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেন তিনি। রাধাবিনোদ পাল এলএলএম পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন এবং আইন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, আনন্দমোহন কলেজের গণিতের শিক্ষক হিসাবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের পর জাপানের অবস্থা তখন শোচনীয়। মিত্রশক্তির মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও উদ্যোগে অভিযুক্ত দেশটির ললাটে এঁটে দেওয়া হয় অপরাধীর তকমা। তাদের, বিশেষ করে মিত্রশক্তির মার্কিন কমান্ডার জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের ওপর অধিকৃত জাপান শাসনের দায়িত্ব পড়ে। তার পরিকল্পনায় জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট।’ যা টোকিও ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালের ২৭ এপ্রিল এই ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিযুক্ত হন রাধাবিনোদ পাল। তখন তিনি কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছিলেন। কারণ দেড় মাস আগে অর্থাৎ ওই বছর ১২ মার্চ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তারও আগে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন তিনি।

১৯৪৫ সালে লন্ডন সনদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়। যা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। জাপানের তৎকালীন সম্রাট হিরোহিতোকে বাদ দেওয়া হয়েছিল এই ট্রায়ালে অভিযুক্তদের তালিকা থেকে।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী তার ‘বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল : এক বাঙালির জাপান জয়’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ট্রাইব্যুনালের ১১ বিচারকের অন্যতম সদস্য হিসাবে বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল বিচারকাজ পরিচালনায় অংশ নেওয়ার জন্য জাপানের রাজধানী টোকিওতে পৌঁছান ১৯৪৬ সালের ৪ মে। ওই দিনই ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু হয়। পরাজিত জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চক্রান্ত, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। প্রায় আড়াই বছর ধরে বিচারকাজ চলে।

যুদ্ধাপরাধের জন্য পঁচিশজনের বিচার হয় এই ট্রাইব্যুনালে। এতে প্রধানমন্ত্রী কোকি হিরোতা, যুদ্ধে জাপানের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী জেনারেল হিদেকি তোজোসহ আরও ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। অন্যদের যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এই বিচারকে ন্যায়ানুগ, আইনমাফিক, নিরপেক্ষ ও যুক্তিসিদ্ধ মনে করেননি ট্রাইব্যুনালের অন্যতম বিচারক ড. রাধাবিনোদ পাল। তাই তিনি এই ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে আলাদাভাবে একক রায় প্রদান করেছিলেন। রাধাবিনোদ পাল আইনি বিচার-বিশ্লেষণে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দায়ে অভিযুক্ত জাপানকে নির্দোষ বলে সাব্যস্ত করেন এবং মিত্রশক্তির প্রধান জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের নেতৃত্বে মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের বিচারকে প্রহসন আখ্যায়িত করেন।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘বাঙালির জাপান আবিষ্কার’ বইয়ে বলেছেন, ‘রক্ষণশীল জাপানিদের মত হলো দূরপ্রাচ্যের এই আন্তর্জাতিক সামরিক আদালত (টোকিও ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল) আদতেই ছিল ভুয়া। এ প্রসঙ্গে লেখক তার বইয়ে টোকিও ট্রাইব্যুনালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোকি হিরোতার ফাঁসির দণ্ড সম্পর্কে দেশটির নাগরিকদের বর্তমান মূল্যায়ন উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেন, ‘কিছু অসঙ্গতি ও দুর্বলতার দিক ইঙ্গিত করে রক্ষণশীলরা ‘যুদ্ধাপরাধ’ সম্পর্কিত টোকিও ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। জাপানের সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় এর প্রভাব রয়েছে।’

রায় সম্পর্কে রাধাবিনোদ পালের প্রশ্ন ছিল, যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এবং নিজেদের শর্ত অনুযায়ী পরাজিত শত্রুদের বিচার করার নৈতিক অধিকার আছে কিনা? তার বক্তব্য ছিল, ট্রায়ালে জাপানকে যেসব অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, অভিযোগকারী পক্ষ (মিত্রশক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) নিজেরাই সেসব অপরাধ করে আসছে। তারা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। নেদারল্যান্ডস ও ফিলিপাইন থেকে আসা ট্রাইব্যুনালের দুই বিচারক রাধাবিনোদ পালকে নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্র্যন্ত তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

শুরু থেকে রাধাবিনোদ পালের ভূমিকা এবং ভিন্নমতের রায়ের মধ্য দিয়েই জাপান বড় ধরনের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে রক্ষা পেয়েছিল। সে সময় বিশ্বের খ্যাতিমান আইনজ্ঞরা ড. রাধাবিনোদ পালের রায়ের উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। রাধাবিনোদ পালের এই রায়ের ফলে জাপান নিজেদের সংশোধন করার সুযোগ পায়। এই রায় জাপানকে সহিংসতার দীর্ঘ পরম্পরা ত্যাগ করে সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

রাধাবিনোদ পাল শুধু রায়ের মধ্য দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করেননি। বিচারের ৪ বছর পরে ১৯৫২ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমার শান্তি স্মৃতি উদ্যানে (পিস মেমোরিয়াল) দাঁড়িয়ে পারমাণবিক বোমা হামলার অষ্টম বার্ষিকীতে জাপানিদের বলেছিলেন, ‘যদি আবার তারা (জাপানিরা) যুদ্ধে জড়ায় তবে হিরোশিমার সেই নৃশংসতায় নিহত নিরীহ মানুষদের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা করা হবে।’

রাধাবিনোদ পালের এই বক্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছেন জাপানিরা। সে বছরই বিচারের রায় মেনে নিয়ে সান ফ্রান্সিসকো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেশটি। এর ফলে জাপানের দখল ছেড়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জাপানিরাও রাধাবিনোদ পালকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘জাপান কখনোই আর যুদ্ধে জড়াবে না এবং সব সময় শান্তির পক্ষে থাকবে।’ সেই থেকে জাপানে শান্তির সূচনা হয়েছে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর