• শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

  • || ১৯ মুহররম ১৪৪৬

বিএনপিতে হতাশা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৬ নভেম্বর ২০২৩  

রাজপথে আন্দোলনের বিষয়ে হার্ডলাইনে বিএনপি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আন্দোলনে কাক্সিক্ষত সফলতা না আসায় দলটির তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা নেমে এসেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচিতে বিরতি না দেওয়ার কৌশল নিয়েছে বিএনপি।

সূত্র মতে, বিএনপি মহাসচিবসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে থাকায় লন্ডন থেকে হাইকমান্ড এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যেতে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়েছে। তবে লাগাতার আন্দোলনের কারণে একদিকে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও অন্যদিকে পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জনসমর্থন হারানোর আশঙ্কায় বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা দেখা দিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ প- হয়ে যাওয়ায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। একদিকে আন্দোলনের হার্ডলাইনে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রোষানলে পড়েছে দলটি। অপরদিকে ২৮ তারিখের আগে সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে যে মনোবল তৈরি হয়েছিল তা অনেকাংশেই ভেঙে গেছে। পক্ষান্তরে বিএনপির ২৮ অক্টোবরের আগের আন্দোলনের গতি দেখে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মনোবল না ভাঙলেও অধিকতর সুবিধাভোগী একশ্রেণির নেতাকর্মী হতাশায় ভুগছিলেন, কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি হার্ডলাইনের আন্দোলনে গিয়ে সফল হতে না পারায় আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী এখন আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়েছে। যে কারণে বিএনপি নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজপথে নামতে পারছে না। বিচ্ছিন্নভাবে মাঝেমধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে ঝটিকা মিছিল করলেও একদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করছে অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতের নাগালে পেলে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

রাজধানীতে ২৮ অক্টোবর সংঘটিত বিভিন্ন সহিংস ঘটনার দায় বিএনপি অস্বীকার করলেও সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে পুলিশ হত্যাসহ ওইসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাঠানো হয়েছে। মূলত এর পর থেকেই আগে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এমন আন্তর্জাতিক মহলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।  

এদিকে আগে বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে থেকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী মহলের সহানুভূতি অর্জন করতে পারলেও এখন সে পরিস্থিতি মোড় নিয়েছে। বিদেশী কূটনীতিক ও সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এখন আর বিএনপির কর্মসূচিকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না। তবে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে পর্দার অন্তরালে বিভিন্ন মহলের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছে। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছে তারা।

সমঝোতার মাধ্যমে কীভাবে বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করা যায় তারই অংশ হিসেবে ৩১ অক্টোবর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ সময় তিনি সিইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই বৈঠকের পর বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানান। কিন্তু  পিটার হাসের এ আহ্বানে অস্বস্তিতে পড়ে বিএনপি।

নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে ৪ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু) সহ ২৬টি দল ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিলেও বিএনপিসহ ১৮ দল যায়নি। তবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল তারপরও বিএনপি চাইলে সংলাপের আয়োজন করা হবে বলে জানান। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, এই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তারা সংলাপে যাবে না।   

উল্লেখ্য, প্রায় এক বছর দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে সারাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক জড়ো করে মহাসমাবেশ সফল করে আন্দোলনের শেষ ধাপে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল তারা। ওইদিনই রাজধানীতে রাজনৈতিক শক্তির মহড়া দিয়ে কঠোর লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কর্মসূচি শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ায় তাদের মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যায়।

সূত্র মতে, ২৮ অক্টোবর দলের কিছু নেতাকর্মীর আচরণ ছিল বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের বিপরীতমুখী। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জোরালো চেষ্টা করা হয়নি। তাই ২৮ অক্টোবর থেকেই বিএনপির আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। এ কারণে মহাসমাবেশ পন্ড হওয়ার পরদিন ২৯ অক্টোবর দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। এর পর প্রথম ধাপে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে টানা ৭২ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন শেষে দ্বিতীয় ধাপে রবিবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে।

বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর একদিনের হরতাল তারপর অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে সারাদেশে অর্ধশতাধিক গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ অনেক সহিংস ঘটনার কারণে দেশ-বিদেশে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিকে রাজপথের আন্দোলন থেকে নির্বাচনমুখী করতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল চাপ দিতে থাকে। কীভাবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দল বিএনপির সমঝোতা করা যায় ভেতরে ভেতরে সে চেষ্টাও চলছে। এ চেষ্টা সফল না হলে বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জনের পথে যেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

বিএনপির মুখপাত্র ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন চলছে। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

এদিকে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠ দখলে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য তারা বিএনপিকে রাজনৈতিকভবে মোকাবিলা করতে আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে রাজপথে সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নেতাকর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও রয়েছে তৎপর।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র দুই মাস বাকি। সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে সকল প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে নির্বাচন কমিশন। ৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সাক্ষাৎ করবে। এর পর নির্বাচন কমিশনের বৈঠক ডেকে এ মাসের মধ্যভাগেই তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। আর নির্বাচনের রোডম্যাপ অনুসারে জানুয়ারির প্রথম ভাগে ভোট গ্রহণের কথা রয়েছে। কিন্তু বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবির প্রতি এখনো পর্যন্ত বিদেশীরা সমর্থন দেয়নি। এমনকি বিএনপি যার ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রেখেছে, সেই মার্কিন রাষ্টদূত পিটার হাসও নির্দলীয় সরকারের কথা বলেননি। বরং তিনি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বেশ ক’বার বৈঠক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। আর বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে হলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের সমর্থনে সংবিধান সংশোধন  করতে হবে। কিন্তু ২ নভেম্বর বর্তমান জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন সমাপ্ত হয়ে গেছে। তাই এখন সরকার রাজি হলেও বিএনপির দাবি অনুসারে নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা আইনগতভাবে করা যাবে না।

দেড় যুগ বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায় আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক শক্তি জোরদার করে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল নেয় বিএনপি। দলীয় হাইকমান্ডের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি হয়ে থাকা বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী গত বছর জুলাই মাস থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ধারাবাহিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় হতে থাকে। আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির দাবি অনুসারে ইতোমধ্যেই ২২ জন মারা যাওয়ার পাশাপাশি মামলা-হামলার শিকার হলেও ২৮ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত তারা মাঠে সক্রিয় ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই রাজপথের আন্দোলন বাদ দিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

গত বছর ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ ও রোডমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শেষে এ বছর ১৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ডাক দেয়। ২৮ অক্টোবর সারাদেশের সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে ঢাকায় জড়ো করতে সক্ষম হয় দলটি। তবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে সমাবেশ সফল করতে পারেনি। আর এর পর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে বিএনপি কৌশল পরিবর্তন করে কি না এ নিয়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর